বাংলা সাহিত্যে জগদীশ গুপ্তের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে জগদীশ গুপ্তের প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে জগদীশ গুপ্তের অবদান ও স্থান


বাংলা কথা সাহিত্যে নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন, তিনি বাংলা কথাশিল্পে বিপরীত স্রোত নির্মাণ করেছেন কিংবা বলা উচিত তিনি স্রোতের বিরুদ্ধে চলে আপন স্বাতন্ত্র ও মহিমাকে প্রতিপন্ন কতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি স্বল্পালোচিত ও বিরল পাঠক লেখক হলেও তার তীক্ষ্ণ ধারালো নতুন ভাবসমৃদ্ধ রচনাগুলি বিদগ্ধ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।


জগদীশ গুপ্তের গল্পগ্রন্থ :

তিনি অন্ততঃ ৩৭টি গ্রন্থ রচনা করেছেন যেগুলি তার সৃজনপ্রতিভার পরিবহ। তার গল্পগ্রন্থ হল— 'বিনোদিনী' (১৯২৭), ‘রূপের বাহিরে’ (১৯২৯), ‘শ্রীমতী’ (১৯৩০), ‘পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক’, ‘শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী (১৯৩৫), ‘মেঘাবৃত অশনি’ (১৯৪৭), জগদীশ গুপ্তের স্ব-নির্বাচিত গল্প' (১৯৫৯, মৃত্যুর পর প্রকাশিত) ইত্যাদি। তার বিশিষ্ট উপন্যাস হল—‘অসাধু সিদ্ধার্থ' (১৯২৯), ‘লঘুগুরু’ (১৯৩১), ‘রোমন্থন' (১৯৩১), 'দুলালের দোলা’ (১৯৩২), 'সুতিনী' (১৯৩৩), 'নিষেধের পটভূমিকায়’ (১৯৫২), ‘কলঙ্কিত তীর্থ' (১৯৬০-মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) ইত্যাদি। এছাড়া অনেক কবিতাও তিনি লিখেছেন।


সাহিত্যিকরূপে জগদীশ গুপ্তর বৈশিষ্ট :

১. জগদীশ গুপ্ত সমসাময়িক লেখকদের চেয়ে ভিন্ন মানসিকতার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের মত কাব্যিক ও রোমান্টিক তিনি কখনোই নন। শরৎচন্দ্রের মত গ্রামজীবন তাঁর অধিকাংশ রচনার পটভূমি হলেও তিনি ভাবালুতাবর্জিত ছিলেন, এবং আইডিয়ালিস্ট ছিলেন না। কল্লোল গোষ্ঠীর শহুরে মধ্যবিত্ত মানসিকতা তাঁর নেই তিনি পল্লীজীবনের রূপকার যে জীবন রূঢ় নির্মম ধূলিধূসর। ‘রোমন্থন’ উপন্যাসে তিনি ধনবান ব্যক্তির পল্লীগ্রাম দর্শনের অভিজ্ঞতায় পল্লীজীবনের নীচতা ও কদর্যতার ছবি ফুটেছে। ‘দুলালের দোলা’ উপন্যাসে এক প্রবাস যুবক বাংলার গ্রামে এসে সেখানকার প্রবল নীচতা সংকীর্ণতা জাতিভেদ ইত্যাদি দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।


২. তিনি মানুষের কথা বলেছেন তবে সেই মানুষ নিষ্ঠুর নির্মম অর্থলোভী এবং কামপীড়িত। মানুষ সভ্যতার প্রলেপবর্জিত তার অকৃত্রিম অমার্জিত রূপ নিয়েই এসেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে। তাঁর চরিত্রগুলির হৃদয়ধর্ম প্রায় নেই, তারা দেহসর্বস্ব ও প্রবৃত্তিনির্ভর। 


৩. মানুষের তীব্র কাম বাসনা এবং নরনারীর যৌন সম্পর্ক তিনি চিত্রিত করেছেন আশ্চর্য নিষ্পৃহভাবে—একে তিনি আবিল বা কলুষিত রূপে অঙ্কন না করে অত্যন্ত বাস্তব ও স্বাভাবিক ভাবেই উপস্থাপিত করেছেন। 


৪. মানুষের প্রবল লোভ ও অর্থ লালসা এবং উৎকট স্বার্থপরতার প্রতিও তার দৃষ্টি ছিল। ‘পয়োমুখম’ গল্পে আছে কবিরাজ কৃষ্ণকান্ত ছেলের বিয়ে দিয়ে পণস্বরূপ টাকা পায়, অতঃপর ওষুধ দিয়ে বধূ হত্যা করে, আবার ছেলের বিয়ে ও বধূহত্যা; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থপিশাচ লোকটি ধরা পড়ে। 


৫. জগদীশ গুপ্ত নিয়তিবাদী: আমাঘ অনিবার্য নিয়তির অভিশাপ তার চরিত্রের ওপর নেমে আসে যা অপ্রতিরোধ্য। 'দিবসের শেষে’ গল্পে রতি নাপিতের বালক পুত্র স্বপ্ন দেখেছিল যে সেদিন তাকে কুমিরে নিয়ে যাবে। সবাই মজা করেছিল, রতিরাও সাবধানে ছিল, কিন্তু সত্যিই সেদিন দিনান্তে নদীতে গেলে কুমির তাকে নিয়ে যায়। 


৬. নারীজীবনের চিত্রণেও লেখক প্রখর, নির্মম ও বাস্তব। নারীর জীবন দুঃখময় বেদনাদীর্ণ; তার সহায় সম্পদ নেইই মূল্যমর্যাদা নেই, আত্মসম্মান নেই—সে পুরুষের অধীন এক সামান্য জৈবিক অস্তিত্ব মাত্র। পুরুষের কাছে নারী দেহস্বর্বস্ব, তার কামনাবাসনা পূরণের উপকরণ বৈ আর কিছু নয়। বিবাহিত পুরুষও নারীকে চাই সহধর্মিণী রূপে নয় কেবল শয্যাসঙ্গিনী রূপে। যদিও সেই নারীও কখনো দেহ চেতনায় প্রকট, বাসনায় জর্জরিত। পুরুষের অপরাধ ও অন্যায়ের জন্য নারীকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। 'কলঙ্কিত তীর্থ' উপন্যাসের প্রথম দিকে দেখা গেছে লম্পট সতকড়ি এক নারীর ওপর অত্যাচার করে কারারুদ্ধ হয়; কিন্তু ঘরে গিয়ে সে মর্যাদা পায় এবং স্ত্রী মাখন ঘৃণায় তাকে প্রত্যাখ্যান করলে সেই স্ত্রী ঘর থেকে বিতাড়িত হয়। 'তাতল সৈকতে' উপন্যাসের নায়িকা শরতও শেষ আশ্রয় পায় যেখানে 'পায়ের নীচে পথের মাটি শীতল—দক্ষিণের বায়ু শীতল। এই শীতলতার মধ্য দিয়ে সম্মুখের অতি-নীরব ও অতি-বিস্তৃত অন্ধকারের দিকে চলিতে চলিতে শরতের বুকের শিরা একটি একটি করিয়া ছিঁড়িতে লাগিল’। মানুষের মনের গভীরেও ঢুকেছিলেন জগদীশগুপ্ত এবং যে রত্ন আহরণ করেছেন তা আপাত সুন্দর না হলেও অত্যন্ত সত্য আপন বৈশিষ্ট্য অনন্য। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন—'মনোবিকলনের জটিলতার মধ্য দিয়ে জীবনরহস্য সন্ধানের পথিকৃৎ জগদীশ গুপ্ত। একদিকে রবীন্দ্রনাথের গল্প, অন্যদিকে প্রভাতকুমারের জনপ্রিয়তা—এ দুয়ের মাঝখানে জগদীশ গুপ্ত অবিশ্বাস্য দুঃসাহসে মনোলোকের গহনে নিঃসঙ্গ যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন'।


তাঁর রচনার ভাবনার মত আঙ্গিকেও আছে নতুনত্ব। তিনি নিছক মুগ্ধতার জন্য প্লট সৃষ্টি করেন নি, প্রকৃতপক্ষে তিনি সচেতনভাবে আঙ্গিক নির্মাণ করেন নি। ‘দুলালের দোলা’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন যে তার লেখায় ‘প্লট’ নেই–‘আমার বক্তব্য ব্যক্ত করিয়াছি মাত্র গল্প তৈরী করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যেমন নতুনত্ব আছে তেমনি ভাষায় এবং প্রকাশরীতিতেও প্রথাবিরোধিতা আছে। তাঁর প্রকাশরীতি অনায়াস ও আপাতমধুর নয়, প্রচলিত সহজ পথে না চলে উপল-বন্ধুর পথেই তার যাতায়াত। তবু জীবনের যে ভাবনাকে তিনি তুলে ধরেছেন তা তিক্ত তীব্র অথচ অনিবার্য সত্য যা বুকের অনিবার্য দাহকে রক্তের অক্ষরে চিহ্নিত করে।