বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-এর অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-এর প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-এর অবদান ও স্থান


সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ওয়ালীউল্লাহ দুই বাংলার সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে এক স্মরণীয় নাম। পাকিস্তান সরকারের বিদেশ দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারি হিসেবেও তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।


১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট নোয়াখালির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের জন্ম হয়। তাঁদের পরিবারের আদি নিবাস ছিল চট্টগ্রামে। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমদুল্লাহ পেশায় ছিলে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহ্ ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। নোয়াখালির ফেনী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার্থে ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় চলে আসেন। তারপর সেন্ট পল্স্ কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে ওয়ালীউল্লাহের ছাত্রজীবন শেষ হয়।


১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পিতা আহমদুল্লাহ ময়মনসিংহে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদে কর্মরত অবস্থায় পরলোক গমন করেন। সেই বছরই অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়ালীউল্লাহ্ কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘দি স্টেম্যান’-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেই সময় ওই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। “দি স্টেম্যান’-এ কর্মরত অবস্থাতেই ওয়ালীউল্লাহ্ ‘কমরেড পাবলিশাস’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। এই প্রকাশনা থেকেই ওয়ীউল্লাহের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রখ্যাত কবি আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয়েছিল। ওয়ালীউল্লাহ্ এখান থেকেই হান্টারের বিখ্যাত গ্রস্ত ‘The Indian Mussalamans' গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সময়ই তিনি Contemporary নামে একটি ইংরেজ গ্রন্থও প্রকাশ করেন।


১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ কলকাতা ছেড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চাল যান। সেখানে ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর নিউজ এডিটর হিসাবে তার নতুন কর্মজীবন শুরু হয়। প্রথমে ঢাকায়, তারপর করাচিতে তার কর্মস্থান নির্দিষ্ট হয়। সেখানে কর্মরত অবস্থাতেই ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। তারপর পাকিস্তান দূতাবাসের ‘প্রেস এটাশে’ পদে যোগ দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ্ ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স আর ভারতে কাজ করেন। তারপর ইউনেস্কোর চাকরি নিয়ে জীবনের শেষ বারো-তেরো বছর বিদেশেই অবস্থান করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সরকারের চাপে তাঁর কর্মচ্যুতি ঘটে।


করাচিতে রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করার সময় সরাসরি দুতাবাসের সেক্রেটারি ফরাসি তরুণী আন মারি ইগের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। অনতিবিলম্বে সেই পরিচয় প্রণয়ে পরিণত হয়। সেই প্রণয়ের সমাপ্তি ঘটে পরিণয়ে। তাদের এক পুত্র এবং এক কন্যার জন্ম হয়।


কর্মজীবনে বিচিত্র দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ালীউল্লাহের সাহিত্য সাধনাও চলতে থাকে। প্রথম যে উপন্যাসটি লিখে তিনি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তার নাম 'লাল সালু'। অচিরকাল মধ্যেই তিনি গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের একজন সার্থক ছোটগল্পকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তবে ওয়ালীউল্লাহের ছোটোগল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়— 'নয়নচারা' (১৯৪৫) আর ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প' (১৯৬৫) নামে দুটি গল্পগ্রন্থেই ওয়ালীউল্লাহের সমস্ত গল্পই সংকলিত হয়েছে। ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনি' এই দ্বিতীয় সংকলন গ্রন্থ থেকেই সংগৃহীত হয়েছে।


এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের মৃত্যু হয় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ই অক্টোবর প্যারিসে নিতান্ত আকস্মিকভাবেই।


ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ার সময় লেখকের প্রথম গল্প 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ (১৯৪১) কলেজে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'লাল সালু' (১৯৪৮) তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল চঁাদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪), ‘কাদো নদী কাঁদো' (১৯৬৮)। তিনি চারটি নাটকও লিখেছেন। সেগুলি হল ঃ ‘বহিপির’ (১৯৬০), ‘উজানে মৃত্যু’, ‘সুড়ঙ্গ’ (১৯৬৪) ও ‘তরঙ্গবঙ্গ’ (১৯৬৫)। '‘নয়নচারা’ (১৯৫১) ও দুই তীর’ (১৯৬৫) নামে তাঁর দুটি গল্প সংকলনও প্রকাশিত হয়, ১৯৭২-এ তাঁর গল্পসমগ্র প্রকাশিত হয়।


ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের মূল রয়েছে তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লাল সালু’ কলকাতা থেকে ১৯৪৮-এ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সূচনাপর্বেই তিনি ছিলেন শক্তিশালী লেখক।


তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালু সালু’-তে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পটভূমি, অতি পরিচিত মানুষ ও সামাজিক পটভূমি চিত্রিত হয়েছে। 'বদ্ধ সমাজের শোষণ ও অত্যাচারের পটভূমিতে ব্যক্তি জীবনজিজ্ঞাসার রূপায়ণ 'লাল সালু'।


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র দ্বিতীয় উপন্যাস 'চঁাদের অমাবস্যা'। এই উপন্যাসের নায়ক গ্রামের স্কুল শিক্ষক আরেফ। উপন্যাসের ঘটনা বলতে তেমন কিছু নেই। বরং চেতনাপ্রবাহরীতি অনুযায়ী ব্যক্তিমনের অন্তঃবাস্তবতাকে মেলে ধরেছেন লেখক।


তার তৃতীয় উপন্যাস 'কাঁদো নদী কাঁদো'। এখানেও মনের অন্তরলোকের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তির সংকট ও সংকট মুক্তির প্রয়াস এবং অসাফল্যের নিপুণ বিশ্লেষণ 'কাঁদো নদী কাদো'।


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র ছোটোগল্পগুলি বিষয়ের অভিনবত্বে, মুসলমান সমাজের সংস্কার বিশ্বাস, রাগ-বিরাগ, আশা-নিরাশার চিত্রণে, চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রয়োগে এবং পরিমিত বোধে উল্লেখযোগ্য। 'নয়নচারা' গল্প সংকলনের গল্পগুলি ব্যক্তিমানসের স্বরূপ উদ্ঘাটনে অভিনব। গল্পের চরিত্রগুলি প্রত্যক্ষ বাস্তবের অন্তরালে ক্রিয়াশীল জীবনসত্যের প্রকাশে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।


১৯৪৮ সালে ‘নয়া সড়ক' পত্রিকায় একটি তুলসী গাছের কাহিনী' প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে গল্পটি পরিমার্জিত হয়ে ১৯৬৫-তে ‘দুই তীর ও অন্যান্য' নামক গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়। তুলসী গাছ হিন্দুদের কাছে একমি ‘মিথ’ (Myth) এই মিথকে গল্পকার সমকালীন জীবনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানুষের মনস্তত্ত্বের উদ্ঘাটনে উপস্থাপিত করেছেন গল্পে।


‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পটিও মন্বস্তরের পটভূমিকায় রচিত। যে মন্বন্তর ব্যক্তিত্ব স্বপ্ন, স্মৃতি সবকিছুকে মুছে দেয় সেই বাস্তব ছবি এই গল্পে অঙ্কিত হয়েছে।


গল্পকার তাঁর 'খুনি' গল্পটিতে একটি অপরাধের অন্তরালে মানুষের অন্তরস্বভাবের স্বরূপ অঙ্কন করেছেন।


‘জাহাজী’ ও ‘পরাজয়’ গল্প দুটিতেও এই শূন্যতার ছবি। এই গল্প দুটিতে সাধারণ অবহেলিত মানুষের নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা চিত্রিত হয়েছে। 'জাহাজী' গল্পে বৃদ্ধ সারেঙ্গ করিম ও ছাত্তার-এর চরিত্র দুটি ব্রাত্য জীবনের ছবিকে ফুটিয়ে তোলে।


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এমন একজন কথাসাহিত্যিক যিনি ছিলেন দেশ-কাল-সচেতন। এই সচেতনতা সমাজে ও সাহিত্যে অবহেলিত মুসলমান সমাজের চরিত্রাঙ্কনে সাহায্য করেছে।


সেলিনা হোসেন তাই বলেছেন, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পূর্ণ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক চাহিদায় চমৎকার মিশেল ঘটিয়ে আমাদের উপন্যাসের দুটো শক্ত খুঁটি স্থাপন করেছেন” সেজন্য শুধু বাংলােদশের সাহিত্যে নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নিজের স্থান করে নিয়েছেন।