উপন্যাসের সংজ্ঞা ও স্বরূপ আলোচনা করো।

উপন্যাসের সংজ্ঞা ও স্বরূপ

উপন্যাস আধুনিককালের গদ্যময় প্রতিমা। যেকোন দেশের সাহিত্যধারায় উপন্যাস ততদিন পর্যন্ত দেখা দেয়নি, যতদিন না তা অনিবার্য হয়েছে। সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় “সমাজে অনুভূত সমস্যা এবং শিল্পের দায় খুব কাছাকাছি এবং প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে, যতদিন না গদ্যের শক্তিসামর্থ্য ও ভারবহন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।” আধুনিককালে গণতান্ত্রিক চেতনায় Self indentity বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা উপন্যাসের জন্ম দিয়েছে। মধ্যযুগে সমাজে সমস্যা ঘনীভূত হলেও এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার অভাব ছিল। দেবতা ও তার প্রতিনিধিদের নিয়েই সাহিত্য রচিত হত। কিন্তু উপন্যাস কোন দেবতা বা দেব প্রতিনিধিদের কাহিনী নয়, এমনকি মধ্যযুগীয় রাজাদের কাহিনীও নয়, উপন্যাসের প্রধান বিষয়; মানবজীবনের পূর্ণায়ত রূপ রচনা।


ইংরাজী Novel শব্দের আনুষঙ্গে বাংলায় উপন্যাস শব্দটি ব্যবহৃত। অবশ্য কোন একসময় উপন্যাস বলতে বোঝাত অলীক মুখরোচক গল্প। 'হুতোম পাচার নক্সা'য় কোলকাতায় বারোয়ারী পুজোর বর্ণনায় জমিদার ছেলে দারোয়ানের গল্প শেষ করে হুতোম মন্তব্য করে-“পাঠক বড় মানুষেরা এই উপন্যাসটি মনে রাখবেন।” যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি উপন্যাস শব্দটিকে ভেঙেছেন এইভাবে উপ’ অর্থে ‘সম্মুখে’ এবং ন্যাস’ অর্থে ‘স্থাপন' অর্থাৎ 'সম্মুখে স্থাপন'। বস্তুত ঔপন্যাসিক তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাকেই পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেন।


ষোড়শ শতকের রাব্‌লের ‘পাতাগ্রুয়েল’ গগতুলা’ বানিয়ানের ‘পিলগ্রিমস্ প্রগ্রেস’ (সপ্তদশ শতাব্দী) প্রভৃতি গদ্যরচনাকে উপন্যাসের পূর্বসূরী ধরা হয়। উপন্যাসের পূর্বরূপ বলতে রোমান্সের কথা আসবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য বিষয় আমাদের অভিভূত করে না। একদিন, বাস্তবতার চাপ বাড়তে থাকে, বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টায় রচনাকাররা মানবজীবনকেই বড়রূপে আশ্রয় করেন। আর অষ্টাদশ শতকে রিচার্ডসন (পামেলা), ফিল্ডিং, স্মোলেট প্রমুখরা ইউরোপে উপন্যাসের প্রতিষ্ঠা করেন।


মানুষের অন্তর্মুখিনতা কবিতার বিষয়, দ্বন্দ্বময়তা নাটকের আর এই অন্তর্মুখিনতা ও দ্বন্দ্বময়তাকে সামাজিক সমস্যা সম্পর্ক সূত্রে গ্রথিত করলে উপন্যাসের অগ্রাধিকার। উপন্যাস তাই সঙ্কর সামাজিক সাহিত্য মাধ্যম। বলা হয় " The novelist has been richer than the poet or the pwilosopher to borrow their specialities, than they have to borrow his." সমাজ জীবনের পটভূমিতে ব্যক্তিজীবনের সমস্যাকে নানা ভাবে চিত্রিতকরা, মনের দূরহবহ রহস্যচেতনা, জীবন সমীক্ষার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য। হেনরী ফিল্ডিং বলেছিলেন—উপন্যাসের উপভোগ্যতা ঔপন্যাসিকের রাসায়নিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। ঔপন্যাসিক জীবনকে দেখেন, মুগ্ধ হন ও তাকে অঙ্কিত করেন নিজস্ব জীবন দৃষ্টির আলোকে।


তাই ঔপন্যাসিকের প্রয়োজনীয় গুণ হল বস্তুজগতের অবারিত তথ্যকে সামঞ্জস্য সূত্রে গেঁথে তুলবার ক্ষমতা। আর সেই সামঞ্জস্য সূত্রটি আবিষ্কৃত হয় ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিগত Vission এর উপর। এখানেই প্রয়োজন নৈব্যক্তিকতা বা নিরাসক্তি। ভার্জিনিয়া উলফ তাই বলেন—চেতনার মধ্যে জীবনের প্রতিটি অণু-পরমাণুর প্রতিফলন প্রকাশ না করলে, সেই প্রতীতির সমস্ত বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন ছকগুলির বিশৃঙ্খল রূপভাসকে সামঞ্জস্যে আনতে না পারলে জীবনের স্বাদ পরিপূর্ণ গভীরতা পায় না।


হ্যানা ক্যাথারিন মুলেন্সের 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’, প্যারীচঁাদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' প্রভৃতি ঊন-উপন্যাস পর্ব এবং বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস ও রোমান্সের মধ্যে দিয়ে যাত্রাশুরু করলেও আধুনিক উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ থেকেই তার প্রকৃত জায়গা খুঁজে পেয়েছে। ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনা নয়, চরিত্রের আঁতের কথা বের করে দেখানোই আধুনিক উপন্যাসের মূল কথা। আর এই সূত্রেই বাংলা উপন্যাসে এসেছে মনস্তাত্ত্বিকতা। শরৎ উপন্যাসে সমাজ প্রাধান্য, মনস্তাত্ত্বিক টানপোড়েনে ছায়া ফেললেও আধুনিক উপন্যাস ক্রমাগতই সমাজ থেকে সরে চরিত্রের অন্তর্গহনে অশ্রয় নিচ্ছে। বা চেতনা প্রবাহ রীতি উপন্যাসের সর্বাধুনিক বৈশিষ্ট্য।