মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে একটি বাংলা উপন্যাসের আলোচনা করো।

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য

উপন্যাস আধুনিক কালের শিল্প হওয়ায়, আধুনিক মানুষের রূপদানে মনস্তত্ত্ব একটি উপন্যাসের অপরিহার্য উপাদান। 'চোখের বালি'র 'সূচনা' অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “সাহিত্যের আধুনিক পর্যায়ের পদ্ধতি হল ঘটনা পরম্পরায় বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে চরিত্রের আঁতের কথা বের করে দেখানো।” উপন্যাস ক্রমাগত পরিধিতলের বাস্তবতা থেকে মানব-মনের নিহিত স্তরের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সামাজিক, ঐতিহাসিক উপন্যাসের মতো মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীকে আজও স্বীকার করা হয়নি। চিহ্নিত করে দেওয়া হয় না, এগুলিই শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এর কারণ মনে করা যেতে পারে মনস্তত্ত্ব ছাড়া উপন্যাস হয় না, এই প্রচলিত ধারণা। কিংবা আধুনিক চরিত্র প্রধান উপান্যাস বা Novel Character নামক শ্রেণীকে স্বীকার করে নেওয়া বা চেতনা প্রবাহমূলক রীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া মানেই উপন্যাসে মনস্তত্ত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া—এ ধারণা থেকেই মনস্তত্ত্ব উপন্যাসের কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী হয় নি।


কিন্তু সমস্ত উপন্যাসেই মনস্তাত্ত্বিক-এ ধারণা করা যায় না। সামাজিক উপন্যাসে যেমন সমাজ চরিত্রকে তার নিজের দিকে টানছে, ঐতিহাসিক উপন্যাসে ইতিহাস যেমন উপন্যাসের চরিত্র ও পরিণতিকে তার নিজের দিকে টানছে, তেমনি এমন কিছু উপন্যাস আছে যেখানে উপন্যাসের সমাজ ও বাইরের পট থেকে চরিত্রগুলিকে মানব মনের গোপন রহস্যের দিকে inner-reality দিকে টানছে—সামাজিক সংঘাত অপেক্ষা ব্যক্তিসংঘাত উপন্যাসে চরম দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে চলেছে। আবর্ত সৃষ্টি করে চলেছে মানব সম্পর্কে সেগুলিকে মনস্তাত্ত্বিক আখ্যা দেওয়াই বুঝি সমীচীন। ঔপন্যাসিকও সমাজ ও পটভূমি বিশ্লেষণ অপেক্ষা মানব মনের রহস্যময় ধূসর জগতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে পড়েন এই উপন্যাস গুলিতে। তাই মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হিসাবে বলা যায়—


  • মানুষের মনই যেহেতু এখানে উপন্যাসের মূল চরাচর ক্ষেত্র, সেহেতু প্রচলিত বাস্তবতার চেয়ে এখানে বড় জায়গা পায় inner-reality বা অন্তর বাস্তবতা।


  • মানব মনের অগ্রগতিতে নির্দিষ্ট কোন শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। মনের ছেঁড়া ছেঁড়া চিন্তা-ভাবনাকে প্রকাশ করতে গিয়ে কাহিনীবৃত্ত সংহত হতে পারে না। কাহিনীর শেষেও 'satifactory totality'-র কোন আভাস থাকে না।


  • মনের ভাবনা-চিন্তাকে প্রকাশ করতে গিয়ে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের লেখকরা আশ্রয় করেন নানা নতুন নতুন কৌশল। এডএয়াড এলবার্ড জানিয়েছেন—"The presentation of the stream of consciousness, the use of interior monologue. The details tracking of the treatise association of ideas, and allusive style were the chief weapons of the novelist to right form within the mind of his characters."

মনের চেতনা তরঙ্গপ্রবাহের মতো প্রবাহিত হয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে একসূত্রে গ্রথিত করে। মনের এই বিচিত্র গতিপ্রবাহের ধারাতেই আধুনিক উপন্যাসে অশ্রয় করা হয় interior monologue, free association, flash back ইত্যাদি কলাকৌশল।


  • মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস আধুনিক যুগের স্বভাবকেই প্রকাশ করে। একদিকে বিংশ শতাব্দীর জটিল পটভূমি, অন্যদিকে ফ্রয়েড, ইয়ুং এ্যাডলার প্রভৃতি মনস্তাত্ত্বিকের আবিষ্কারে মানুষ তার সমস্ত মূল্যবোধকেই হারাতে বসেছিল। ক্রমাগতই মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিঃসহায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, বাইরের সমাজ থেকে বিশেষ কোন চেতনা বা মূল্যবোধকে না পাওয়ায় মানুষ নিজের চারিদিকে পরিখা রচনা করে চলেছে। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস মানুষের এই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, বাইরের সমাজ থেকে বিশেষ কোন চেতনা বা মূল্যবোধকে না পাওয়ায় মানুষ নিজের চারিদিকে পরিখা রচনা করে চলেছে। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস মানুষের এই আত্মকেন্দ্রিকতাকেই রূপ দেয় এবং সার্থক ঔপন্যাসিক বুঝিয়েও দেন এভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় সভ্যতার কিংবা মানুষের কারোই মুক্তি নেই। প্রকৃতিতে গোষ্ঠীবদ্ধভাবেই মানুষ নিজের অস্তিত্বকে বজায় রাখতে পেরেছে। তাই আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হতেই হবে মানুষকে।


বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ‘সুমতি’ ‘কুমতি’র দ্বন্দ্বে মনস্তত্ত্বের বীজ ছিল। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে কাহিনী প্রাধান্য এবং নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সে জটিলতা বিশেষ অগ্রসর হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনীকে স্বাধীনতা দিয়ে উপন্যাসে প্রকৃতার্থে মনস্তত্ত্বের ব্যবহারকে স্বীকৃতি দিলেন। ‘চতুরঙ্গে’-এর সার্থক প্রকাশ লক্ষ্য করা গেল। শচীশের আস্তিকতার, দ্বন্দ্ব, দামিনীর আকর্ষণ প্রভৃতিতে মানব মনের অন্তর্দ্বন্দ্বকেই ঔপন্যাসিক প্রাধান্য দেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে যে অবক্ষয় সারা পৃথিবীতে দেখা গেল তার প্রতিফলন হিসাবে কল্লোলীয়দের হাতেই মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস আধুনিক রূপ নিয়েছে।


তিরিশের দশকের অন্যতম ঔপন্যাসিক ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ত্রয়ী উপন্যাস ‘অন্তঃশীলা’, ‘আর্বত’, ‘মোহন’ নামকরণেই মনস্তাত্ত্বিকতাকে ধরিয়ে দেয়। এ উপন্যাসে যে কাহিনী নেই তা বলা যায় না. কিন্তু সে কাহিনী বর্হির্দ্বন্দ্ব অপেক্ষা চরিত্রের মনোজগৎকেই দীপ্ত করে তুলেছে। খগেনবাবুর অন্তঃশীলা জীবন পিপাসা, সংঘাতের নানা অভিজ্ঞতার আত্মনিরীক্ষার জটিল আর্বতগুলি পেরিয়ে মোহনায় উপনীত হয়ে খুঁজে পেয়েছে বেঁচে থাকতেই মানুষের সার্থকতা। মার্শাল প্রুস্ত কিংবা জেম্স জয়েসের প্রভাবে প্রকাশিত লেখক Stream of consciousness কেই ব্যবহার করেছেন উপন্যাসের প্রকাশ কৌশল হিসাবে। প্রথম পরিচ্ছেদে স্ত্রীর শবদাহ দেখতে দেখতে খগেনবাবুর যে চিন্তাধারা তা নিঃসন্দেহে চেতনা প্রবাহেরই প্রকাশ। নিঃসন্দেহে এই ত্রয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে সার্থক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।