চন্দ্রশেখ [ প্রশ্নের মান ৫ ]

চন্দ্রশেখ

[ প্রশ্নের মান ৫ ]


১। শৈবলিনী বিবাদের মালা তাহার শৃঙ্গে পরাইয়া আসিল; তখন বিবাদ মিটিল।

এক সন্ধ্যায় প্রতাপ এবং শৈবলিনী ভাগীরথীর তীরে বসে খেলা করছিল। এ সময়ে কিছু বন্য কুসুম চয়ন করে শৈবলিনী একটি মালা গাঁথে এবং সেই মালা প্রথমে প্রতাপের গলায় পরিয়ে আসে, তারপর পরে মালাটি আবার খুলে এনে নিজের কবরীতে পরে নেয়। তারপর তা খুলে ফেলে। মালাটি কে পরবে এই নিয়ে কিছুক্ষণ বিবাদ চলার পর সেই মালাটি নিয়ে একটি হৃষ্টপুষ্ঠ গাভীর শিং-এ পরিয়ে আসে। লেখক এখানে বুঝিয়েছেন যে এর মধ্যে কি ভবিষ্যৎ লুকিয়ে নেই। বিবাদ শব্দের মাধ্যমে মালা সম্পর্কে বিরোধকে বোঝান হয়েছে। গাভীর শৃঙ্গকে নির্দেশ করা হয়েছে ‘তাহার' শব্দের মাধ্যমে। গভীর শৃঙ্গে মালাটি পরাবার ফলেই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়।


২। শৈবলিনী তখন সাত আট বৎসরের বালিকা—প্রতাপ কিশোর বয়ষ্ক।

নায়ক নায়িকার বয়সের ইঙ্গিত আছে এই অংশে। উপন্যাসের মূল ঘটনা শুরু হবে আরও আট বছর পরে। উপক্রমণিকায় দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের প্রতাপের সময় যোলো বলে উল্লেখ করা হয়েছে, আর তৃতীয় পরিচ্ছেদে জানানো হয়েছে চন্দ্রশেখরের বয়স বত্রিশ। অর্থাৎ তিনটি পরিচ্ছেদে ক্রমান্বয়ে কাল্পনিক অংশের তিন চরিত্রের বয়সের ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদেই লেখক নায়িকা শৈবলিনী বয়সের কথা এখানেই জানালেন।


৩। শৈবলিনীর প্রথম হিসাব ভুল-

শৈবলিনী যখন প্রতাপকে ভালোবেসেছিল তখন তার বয়স ছিল আট বছর। সে মনে মনে জানত যে প্রতাপের সঙ্গে তার বিবাহ হবে। কিন্তু প্রতাপ জানত এই বিবাহ হবে না। শৈবলিনী ছিল প্রতাপের জ্ঞাতি কন্যা। সম্পর্ক দূর হলেও এই বিবাহ সম্ভবপর ছিল না। এই জ্ঞাতি সম্পর্কের কারণটি শৈবলিনীর বিবেচনার না থাকাকে লেখক প্রথম হিসাবে ভুল বলে উল্লেখ করেছেন।


৪। শৈবলিনী এই আমাদের বিয়ে-

প্রতাপ শৈবলিনীকে এই কথা বলেছিল। ষোলো বছরের প্রতাপ এবং আট বছরের শৈবলিনী পরস্পরেকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু শৈবলিনী ছিল প্রতাপের জ্ঞাতি কন্যা। জ্ঞাতি কন্যাকে বিবাহ করা করা যায় না। এক সময় তারা বিষয়টি অনুভব করে এবং বেদনাহত চিত্তে আত্মবিসর্জন সংকল্প করে। একদিন তারা দুজনে পরামর্শ করে গঙ্গাবক্ষে নিমজ্জিত হতে চাইল। দুজনে বহুদূরে গিয়ে নিমজ্জিত হতে প্রস্তুত হল। আত্ম বিসর্জনের পূর্বে প্রতাপ বলেছিল—“এই বিয়ে আমাদের”


৫। মনে ভাবিল কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে?

শৈবলিনী তার বাল্যসঙ্গী খেলার সাথি প্রতাপকে ভালোবেসেছিল। প্রতাপ ছিল শৈবলিনীর জ্ঞাতিকন্যা। সম্পর্ক দূর হলেও জ্ঞাতি তাই তাদের বিবাহ হওয়া সম্ভবপর ছিল না। এই অবস্থার শৈবলিনী ও প্রতাপ তারা দুজনেই আত্মবিসর্জনে প্রস্তুত হল। একদিন শৈবলিনীও প্রতাপ সাঁতার কাটতে কাটতে গভীর গঙ্গাবক্ষে উপস্থিত হল এবং সংকল্প অনুযায়ী প্রতাপ জলে ডুবে যায়। প্রতাপকে ডুবতে দেখে শৈবলিনী ভয় পায়, সে মরণের সংকল্প ত্যাগ কে সে নিজের মতো পরিবর্তনের সময় স্বগোতোক্তি করেছিল—“কেন মরিব ? প্রতাপ আমার কে?

প্রতাপ এবং শৈবলিনীর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের প্রসঙ্গটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। শৈশব থেকেই প্রতাপ দৃঢ় সংকল্প এবং সুনির্দিষ্ট আদর্শে আস্থাশীল। সে দিকভ্রষ্ট হয় না। কিন্তু শৈবলিনী শৈশব থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে অস্থির প্রকৃতির এক চরিত্র। ব্যক্তিগত স্বার্থই তার কাছে সবচেয়ে বড়ো। এই জন্য নীতি আদর্শে অবিচল থাকতে সে অক্ষম। উপন্যাসের পরবর্তী অংশেও শৈবলিনীর আচরণের বিষয়টি লক্ষ্য করা যাবে।


৬। সংযমীর ব্রত ভঙ্গ হইল/ সৌন্দর্যের মোহে কে না মুগ্ধ হয়?

চন্দ্রশেখর বত্রিশ বছর অতিক্রম করেছিল কিন্তু তিনি বিবাহ করেননি। কারণ জ্ঞান সাধনায় তার বিঘ্ন ঘটবে এটা মনে করেই তিনি বিবাহ করা থেকে দূরে থাকেন। বৎসরাধিক কাল পূর্বে চন্দ্রশেখরের মাতৃবিয়োগ হয়। নিজের হাতে রান্নার কাজ করতে হয়। দেব সেবা ও অধ্যায়ন ও অধ্যপনার কাজে খুবই অসুবিধা হতে লাগল। তাই তিনি বিবাহ করবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু তিনি সুন্দরীকে বিবাহ করবেন না। কারণ সুন্দরীর দ্বারা মন মুগ্ধ হওয়ার সম্ভবনা। কিন্তু শৈবলিনীকে দেখার পরে চন্দ্রশেখরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হল। তিনি নিজেই ঘটক হয়ে শৈবলিনীকে বিবাহ করেন। এইজন্য লেখক মন্তব্য করেছেন সে “সৌন্দর্যের মোহে কে না মুগ্ধ হয় ?”


৭। মেঘাচ্ছন্ন দিনে স্থল কমলিনীর ন্যায়, মুখ যেন ফোটে ফোটে তবু ফোটেনা—

দলনী বেগমের সঙ্কোচে আচারণের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এই উপমাটি ব্যবহার করা হয়েছে। সূর্য কিরণ সম্পাতে স্থল পদ্মের পূর্ণ বিকাশ ঘটে মেঘাচ্ছন্ন দিনে স্থল পদ্ম পূর্ণ বিকশিত হয় না। নবাবের সম্মুখে দলনীয় বেগম লজ্জা ও সঙ্কোচের বশে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছিলেন না। উদ্ধৃত উক্তির সাহায্যে সেই বিষয়টিকেই নির্দেশ করা হয়েছে।


৮। আমি সিরাজ-উদদৌলা নহি বা মীরজাফরও নহি।

আলিবদ্দীর দৌহিত্র সিরাজ-উদদৌলা ১৭৫৬খ্রী, বাংলা, বিহার, ওড়িষার নবাব হন। আলিবর্দীর তাঁকে উত্তরাধিকারী মনোনিত ছিলেন। আলিবর্দীর নিকট আত্মীয়রা, বিভিন্ন বৃদ্ধ পুরুষের এবং রাজবল্লভ ও জগৎ শেঠ প্রমুখরা সিরাজ-উদদৌলার বিরোধী ছিলেন। ইংরেজরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। ১৭৫৭খ্রীঃ ২৩শে জুন। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের বাহিনী পরাজিত হয়। এদিন মীরজাফর ও অন্যান্যরা সিরাজ-উদদৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকেন। নবাব রণক্ষেত্রে থেকে পলায়ণ করলেও পরে ধরা পড়েন। সিরাজ-উদদৌলা ছিলেন রাজনীতির অজ্ঞ এবং মীরজাফর ব্যক্তিত্বহীন। মীরকাসিমের তাঁর পূর্ববর্তী দুই নাবাবের সঙ্গে তুলনা করে বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর চরিত্র ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি অবিবেচকও নন, ব্যক্তিত্বহীনও নন।


৯। .....মুরশিদাবাদের অনতি দূরে বেদগ্রাম নামে স্থান আছে—তথায় চন্দ্রশেখর নামে একজন বিদ্বান ব্রাহ্মণ বাস করে— সে আমাকে গণনা শিখাইয়াছিল….

‘সময়ের উল মৃতক্ষরীণ’-এ আছে মীরকাশিম নাকি জ্যোতিষ শাস্ত্রে অনুরাগী ছিলেন। তিনি নিজেও জ্যোতিষ চর্চা করতেন। প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদ শুরু হয়েছে ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনা করে। নবাবের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ঘটনার সঙ্গে প্রথমে সুকৌশলে ইতিহাস সংশ্লিষ্ট কাল্পনিক চরিত্র দলনীকে আনলেন; পরে কাল্পনিক অংশে এবং মূল কাহিনির নায়ক চন্দ্রশেখরকে যুক্ত করে ইতিহাসাশ্রিত রোমান্সের ভিত্তিভূমিটি প্রস্তুত করলো সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম।


১০। চাঞ্চল্য মাত্রে তরঙ্গ উঠে, তেমনি তরঙ্গ উঠিল—

বঙ্কিম দলনী বেগমের সৌন্দর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে একথা বলেছেন। গভীর জলাশয়ে আপাত দৃষ্টিতে শাস্ত থাকলেও কোনও কারণে তাতে যদি চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সেখানে তরঙ্গ মালার সৃষ্টি হয়। রূপসী দলনীর রূপ অগাধ সলিলের মতই নিস্তরঙ্গ। কিন্তু যখন বেগম অঙ্গ সঞ্চালন করেছেন তখন গৃহ মধ্যে যেন রূপের তরঙ্গ সৃষ্টি হল।


১১। ঘরে যাবনা লো সই/আমার মদন মোহন আসচে ওই !–

শৈবলিনীর চরিত্র অনুধাবনের জন্য উদ্ধৃত অংশটি তাৎপর্যমণ্ডিত। আপাত দৃষ্টিতে শৈবলিনীর দুর্ভাগ্যের কারণ বহিরাগত আঘাত; কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল শৈবলিনীর নিজের তৈরি করা একটা পটভূমি। ফস্টর যে আকস্মিক আবির্ভূত বাইরের একটি উৎপাত মাত্র নয় তা বোঝা যায় উদ্ধৃত উত্তিতে। ঘরে যাওয়ার সময় হওয়া সত্ত্বেও সে ঘরে যেতে চায়নি। ফস্টরকে দেখে আরও কিছুক্ষণ জলে থাকতে চেয়েছে। মদন মোহন ব্যবহার ও তাৎপর্য মন্ডিত পরে জানা গেল ফস্টরের সঙ্গে শৈবলিনীর এই পরিচয় একদিনের নয়। সে ফস্টরকে প্রশ্রয় দিয়েই জীবনে বিপর্যয়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।


১২। মেঘ মধ্যে, অচলা সৌদামিনী হাসিল ভীমার সেই জলতরঙ্গে এই স্পর্শ কমলা ফুটিল–

‘সৌদামিনী' শব্দের অর্থ 'বিদ্যুৎ'। ভীমার কালো জলে শৈবলিনী বক্ষ পর্যন্ত নিমজ্জিন করে মস্তক উপরে রেখে জলের মধ্যে বসেছিল বঙ্কিমচন্দ্র শৈবলিনীর এই মস্তককে প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কালো মেঘের অন্তরালে থেকে বিদ্যুৎ সেভাবে আত্ম প্রকাশ করে, সেইভাবে ভীমার জল মধ্যে যেন অচলা সৌদামিনী হাসল, সেই হাসিতে ভীমার তরঙ্গে মনে হল একটি স্থল কমল ফুটেছে।


১৩। কটা চক্ষু অপেক্ষা কাল চক্ষু ভালো এবং কটা চুলের অপেক্ষা কাল চুল ভালো –

ফস্টরের প্রসঙ্গে এই অভিমত। অল্প বয়সে সে মেরি ফস্টরকে ভালোবেসে হতাশ হয়েছিল। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে বাংলায় আসে। সেখানে সে শৈবলিনীকে দেখে। এরপর মেরির জায়গায় শৈবলিনী তাঁর হৃদয় আসনে স্থান পায়। ইংরেজ রমণী মেরির চুল এবং চোখের রং কটা। মেরির বদলে শৈবলিনী তাঁর হৃদয় আসনে স্থান পায়। ইংরেজ রমণী মেরির চুল এবং চোখের রং কটা, অন্যদিকে ভারতীয় রমণী শৈবলিনীর চুল এবং চোখের রং কালো। মেরির বদলে শৈবলিনী যে তার আকর্ষণের বস্তু হয়েছে সেকথা বোঝাতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র এই কৌতুককর অভিমত প্রকাশ করেছেন।


১৪। বিধাতা তাঁকে সংগড়িয়া, রাঙ্গতা দিয়া সাজান নাই—মানুষ করিয়াছেন—

কথা প্রসঙ্গে শৈবলিনী সুন্দরীর কাছে তার অতৃপ্ত দাম্পত্য জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করলে সুন্দরীর একথা বলেছিল। চন্দ্রশেখর ধর্মাত্মা পণ্ডিত। তাঁর সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্য আছে। বালক যেমন খেলা ঘরের পুতুল নিয়ে খেলা করে চন্দ্রশেখরকে বিধাতা রাঙ্গতা দিয়ে সং-এর মতো সাজান নি। তাঁকে মানুষ করেছেন। চন্দ্রশেখরের ভালোবাসার অভিব্যক্তি স্বতন্ত্র। শৈবলিনীর দুভার্গ্য যে সেই ভালোবাসার গভীরতা অনুধাবন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।


১৫। অগ্নি জ্বলিল—

শৈবলিনীর বিরহে কাতর হয়ে চন্দ্রশেখর তাঁর রাশিকৃত গ্রন্থ ও পুঁথিগুলিতে অগ্নি সংযোগ করেছিলেন। একথাকে বোঝাবার জন্যই লেখক অগ্নি জ্বলিল' শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু অগ্নি শব্দের তাৎপর্য এখানে আরও ব্যাপক। চন্দ্রশেখরের মনের মধ্যেও আগুন জ্বলেছিল। তাঁর পূর্বকৃত ঔদাসীন্য এবং শৈবলিনীর অপহরণ তাঁর মধ্যে যে মন্ত্রণা সৃষ্টি করেছিল তার ইঙ্গিতও আছে উদ্ধৃত অংশে। উল্লেখ্য যে, এরপর থেকেই উপন্যাসে যাবতীয় বিরোধ দ্রুত রূপ লাভ করতে লাগল।


১৬। এসকল কর্ম্মে স্ত্রীলোকের পরামর্শ আগ্রহ।

গুগণ খাঁ দলনী বেগমকে একথা বলেছিলেন। ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করা উচিত নয় কেন সে কথা দলনী বেগম গুরগণ খাঁকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গুর-গণ খাঁ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন। বৃহৎ রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে স্ত্রীলোকের পরামর্শ গ্রহণকরা গুরগণের পক্ষে অবাঞ্ছিত। এই অভিমতে নারীজাতি সম্পর্কে সেকালের ধারণাটিও ব্যক্ত হয়েছে। দলনী বেগমের অভিমত অগ্রাহ্য করা হয়েছে যুক্তির ভিত্তিতে নয়, যেহেতু সেই হেতু একথাটি বলেছিল।


১৭। ভবিতব্য কে খণ্ডাইতে পারে? যাহা ঘটিবার তাহা অবশ্যই ঘটিবে। তাই বলিয়া পুরুষকারকে অবহেলা করা কর্তব্য নহে—

দলনী বেগমের পরিচয় জানার পর চন্দ্রশেখর তাঁর ভগবানকে এভাবে প্রকাশ করেছেন। ইতিপূর্বে তিনি মুরশিদাবাদে গিয়ে দলনী বেগমের ভাগ্য গণনা করেছিলেন। ফলা ফল যে শুভ হয়নি সে কথা তিনি গণনা করে জেনেছিলেন দলনী বেগমের পরিচয় পেয়ে বুঝেছিলেন যা ভবিতব্য, তা ঘটতে চলেছে। তবুও তিনি দলনীর উপকার সাধনে প্রয়াসী হবেন বলে স্থির করেছেন। জ্ঞানী মানুষ চন্দ্রশেখর পুরুষকারকে অগ্রাহ্য করতে চান না। এই উক্তি চন্দ্রশেখরের চারিত্রিক মহিমার নির্দেশক।


১৮। তাঁহার চরিত্র লিখিতে লিখিতে কলুষিতা আমার এই লেখনী পূণ্যময়ী হইবে—

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতাপের চরিত্র লিখতে লিখতে কলুষিত শৈবলিনীয় তাঁর লেখনী স্পর্শে পুণ্যময়ী হয়েছিল। এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের নৈতিক সত্তাটি আত্মপ্রকাশ পেয়েছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে শৈবলিনীর আচারণকে সমর্থন করেননি এজাতীয় বিবরণ তাঁহারই নিদর্শন।


১৯। লোকে বড়ো মানুষ হইলে পূর্ব্ব কথা ভুলিয়া যায়—

সুন্দরী প্রতাপকে একথা বলেছিল। শৈবলিনীর অপহরণের সংবাদ শুনে প্রতাপ সুন্দরীকে অভিযুক্ত করে বলেছিল এই সংবাদ তাঁকে আরও পূর্বে দেওয়া উচিত ছিল। বিশেষত, তার সবকিছুর মূলেই রয়েছে চন্দ্রশেখর। তখন সুন্দরী কটাক্ষ করে একথা বলেছিল। জগতের নিয়ম হল এই যে, মানুষ বড়ো হলে পূর্বে যার কাজ থেকে উপকার পেয়েছে। তার কথা সে ভুলে যায়। প্রতাপের পক্ষেও এটা ঘটাই স্বাভাবিক।


২০। হিন্দু তেল পোড়ায় না—খরচ হইবে—

গষ্টন্‌ জন সন্‌কে একথা বলেছিল। ভারতীয়দের বোঝাতে এখানে হিন্দু শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেকালের ভারতীয়রা সন্ধ্যার কিছু পরেই ঘুমিয়ে পড়ত। গ্রামাঞ্চলে এখনো এই রীতিলক্ষ্য করা যায় ইংরেজরা অধিক রাত্রি পর্যন্ত জেগে নানাবিধ আমোদ স্ফুর্তি করে। ভারতীয়দের প্রতিব্যঙ্গ করেই ইংরেজ গলষ্টন—একথা বলেছিল।


২১। সে শৈবলিনী পতঙ্গের জলন্ত বহ্নি—সে এই সংসার প্রান্তরে আমার পক্ষে নিদাঘের প্রথম বিদ্যুৎ—সে আমার মৃত্যু—

প্রতাপের সম্পর্কে শৈবলিনীর উপলব্ধি। প্রতাপকে ধরে নিয়ে যাবার পর শৈবলিনী একাকি যখন প্রতাপের বাসায় অবস্থান করছিল, তখন তার মনে এই ভাবনার উদয় হয়। প্রতাপকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতাপের ভাবনায় ভাবনায় শৈবলিনী যখন ব্যকুল তখন সে পুনরায় প্রশ্ন করেছে ‘প্রতাপ আমার কে? আমি তাহার চক্ষে পাপিষ্ঠা। শৈবলিনীর মনে হয়েছে প্রতাপ শৈবলিনী পতঙ্গের জলন্ত বহ্নি, এবং সংসারে প্রান্তরে নিদাঘের প্রথম বিদ্যুতের মতো বঙ্কিমচন্দ্র মানুষের জীবনের বিভিন্ন প্রবৃত্তিগুলিকে বহ্নির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন—–রূপ-বহ্নি-জ্ঞান বহ্নি, মান-বহ্নি ইত্যাদি। মানুষ পতঙ্গের মতো সেই বহ্নির প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সেখানে পুড়ে মরে। শৈবলিনীর জীবনেও প্রতাপ এমনই এক বহ্নি। সেই রূপ মোহের আগুনে দগ্ধ হওয়া ছাড়া তার জীবনের কোনও গতি নেই।


২২। জানিতাম না যে, মনুষ্যে গড়ে, বিধাতা ভাঙ্গে—

মানুষ তার ইচ্ছা অনুযায়ী স্বপ্ন দেখে, জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা গ্রহণ করে, কিন্তু বিধাতার খেয়ালে সেই পরিকল্পনা ভেঙে যায়, ইংরাজীতে একটি প্রবাদ আছে 'Man proposes God disposes'। উদ্ধৃত অংশতে তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। শৈবলিনী প্রতাপকে ধরার জন্য গৃহত্যাগ করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতাপই ইংরেজের হাতে বন্দি হল। যার ফলে তার সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হল।


২৩। আজিও এ মরা গঙ্গায় চাঁদের আলো কেন?

গঙ্গা বক্ষে সাঁতার কাটার সময় শৈবলিনী প্রতাপকে এই কথা বলেছিল। উক্তিটির অপরূপ কাব্য সুষময় মণ্ডিত। এখানে মরা গঙ্গা শব্দটি রূপসার্থক। শৈবলিনী প্রতাপের জীবন—নদীর প্রণয় প্রবাহে ভাঁটার টানে চলছে। পূর্ণিমায় গঙ্গায় ভরা কোটালের সৃষ্টি হয়। কিন্তু শৈবলিনী প্রতাপের জীবনের স্রোত শুষ্ক হয়ে পড়েছে। সেখানে চাঁদের আলোর প্লাবন অযৌক্তিক। শৈবলিনীর জীবনে সুখের আশা অন্তর্হিত হয়েছে। কাজেই পুরাতন সম্বোধনে, অতীতের স্মৃতি চারনের কোনও প্রয়োজন নেই।


২৪। “তুমি কে? দেবতা না মনুষ্য” –

প্রতাপের সান্নিধ্য থেকে শৈবলিনী পলায়ন করে এক পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। এক সময় সেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিল। ঝড়-বৃষ্টিতে যখন শৈবলিনী বিপন্ন তখন চন্দ্রশেখর তাকে ধারণ করে পর্বত গুহায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অন্ধকারের শৈবলিনী চন্দ্রশেখরকে চিনতে পারেনি। তাই কাতর ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল—কে তাকে ধারণ করেছেন? তিনি কি দেবতা না মানুষ ?


২৫। শৈবলিনীর চিত্তে চির প্রবাহিত নদী ফিরিল—

একাগ্র চিত্তে স্বামীর ধ্যান করতে করতে শৈবলিনীর মধ্যে পরিবর্তন এল। শৈবলিনী প্রতাপকে ভুলে চন্দ্রশেখরকে ভালোবাসল। শৈবলিনীর মধ্যে এই পরিবর্তনকে লেখক ‘চিত্তে চির প্রবাহিত নদী ফিরিল' বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের দাম্পত্য প্রেমের শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকৃত। নারীই স্বামীর অবলম্বন। এই স্রোতেই চিরস্তন জাতীয় ভাবধারা প্রবাহিত হয়। শৈবলিনী দাম্পত্য সম্পর্ক বহির্ভূত প্রেমের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্বামীর প্রতি যে অনুরাগ প্রদর্শন করেছে তাকেই চির প্রবাহিত নদীর রূপকে বর্ণনা করা হয়েছে।


২৬। সে রজ্জুতে সর্প দেখিল—

মানুষ স্বতন্ত্র অবস্থায় দড়িকে ও সাপ বলে ভুল করে। ফস্টরের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছিল ফস্টরের নৌকার পিছনে একটা ক্ষুদ্র নৌকা আসছিল। ফস্টর ভাবলেন নবাবের বাহিনী তাঁকে অনুসরণ করছে। তাই ভয় পেয়ে ফস্টর দলনীকে নামিয়ে দিয়েছিল।


২৭। সপ্ত সিংহ যেন জাগিয়া উঠিল—

রামানন্দ জানতে চেয়েছিলেন প্রতাপ শৈবলিনীকে ভালোবাসে কিনা? রণক্ষেত্রে আহত হয়ে প্রতাপ তখন মৃত্যু পথযাত্রী। এই অবস্থাতে ও প্রতাপ সুপ্ত সিংহের মতো জেগে উঠল। সে জানিয়েছে, ষোলো বছর ধরে সে শৈবলিনীকে ভালোবেসেছে। সে পাপচিত্তে শৈবলিনীর প্রতি অনুরক্ত হয়নি, তার ভালোবাসার নাম জীবন বিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।


২৮। এক বোঁটায় আমরা দুইটি ফুল। এক বন মধ্যে ফুটিয়াছিলাম—ছিঁড়িয়া পৃথক করিয়াছিলেন কেন?

চন্দ্রশেখরের প্রশ্নের উত্তরে শৈবলিনী একথা বলেছিল। শৈশবে শৈবলিনীও প্রতাপ এক গ্রামে পাশাপাশি মানুষ হয়েছিল। বন্য কুসুমের মতই তারা এক বৃত্তে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। চন্দ্রশেখর শৈবলিনীকে বিবাহ করে বৃত্তচ্যুৎ করেছিলেন। প্রতাপের কাছ থেকে তাকে পৃথক করেছিল। শৈবলিনী একারণে প্রতাপের জন্যই ফস্টরের সঙ্গে গিয়েছিল।


২৯। দলনী পতঙ্গ বহ্নিমুখে বিবিক্ষু হইল—

চন্দ্রশেখরের প্রস্তাব অনুযায়ী দলনী বেগম মুরশিদাবাদে তকিখাঁর কাছে যেতে সম্মত হলেন। এই সিদ্ধান্ত দলনী বেগমের পক্ষে সমূহ বিপদের কারণ হয়েছিল। আগুনকে দেখলে পতঙ্গ সেদিকে ধাবিত হয়, আগুনের মধ্যে প্রবেশ করতে চায়। পতঙ্গ জানে না সে আগুনে প্রবেশ করলে তার মৃত্যু হবে। দলনী ও এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের অজ্ঞাতেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। এই জন্যই লেখক দলানী বেগমকে বহ্নি মুখ বিবিক্ষু পতঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন।


৩০। জলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়িল—

মীরকাসেম সম্পর্কে এই অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর নবাবের জীবনে একে একে দুর্ভাগ্য দেখা দিতে লাগল। তিনি প্রথমে কাটোয়ায় যুদ্ধে হেরে গেলেন। তারপর গুরগণ খাঁর বিশ্বাসঘাতকাতা প্রকাশ পেল। এমন সময় তকি খাঁ প্রেরিত দলনী সম্পর্কিত মিথ্যা সংবাদ নবাবের কাছে পৌঁছাল। নবাব এই সংবাদে আত্মহারা হলেন। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে যেমন তা প্রবল আকার ধারণ করে, তেমনই মীরকাসেমও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি শব্দের মাধ্যমে এই বিষয়টিকে বুঝিয়েছেন।