সার্থক সামাজিক উপন্যাস বলতে কোন শ্রেণীর উপন্যাসকে বলা হয়। একটি বাংলা সামাজিক উপন্যাসে আলোচনা করো।

সার্থক সামাজিক উপন্যাস

আধুনিক সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন-উপন্যাস রচিত হতে পারে না যতদিন পর্যন্ত সমাজে অনুভূত সমস্যা এবং শিল্পের দায় খুব কাছাকাছি এবং প্রায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছে। রোমান্সের খোলস মুক্ত হয়ে যে উপন্যাসের জন্ম, সে উপন্যাসের দাবী ছিল বাস্তবতা, পাঠকের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা। তাই উপন্যাস নেমে আসে মাটির সংসারে। জীবনের কাছাকাছি। উপন্যাসের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। জীবনকে মানুষ অনুভব করবে, জীবনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ এই শিল্পকেও সে অনুভব করবে, (হেনরী জেম্স)। জীবনের পূর্ণায়ত রূপ সন্ধান এবং জীবনই উপন্যাসে আশ্রয় পায় বেশি। আর স্বাভাবিকভাবেই উপন্যাস হয়ে ওঠে বস্তুনিষ্ঠ, সমাজ ঘনিষ্ঠ শিল্প। উপন্যাসে সামাজিক অবস্থান বা পটভূমি ব্যবহৃত হয় বেশি। কিন্তু সামাজিক প্রসঙ্গের উল্লেখ থাকলেই সঠিক অর্থে সামাজিক উপন্যাস আখ্যা পায় না যে কোন উপন্যাস। সামাজিক উপন্যাসের স্বরূপ এককথায় বলতে গিয়ে আব্রাহাম লিখেছেন- "The Sociological novel emphasites the influence of social and economic conditions of charachers and event."


অর্থাৎ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার স্বরূপ উদ্ঘাটানই এই শ্রেণীর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে সমাজ সংস্কারের বাসনা উপন্যাসের থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে-বাসনা যদিও থাকে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট থাকে। সামাজিক সমস্যার নির্দিষ্ট সমাধান নয়, বরং সমস্যাটির প্রতিফলনের দিকেই সামাজিক উপন্যাসের রচয়িতার আগ্রহ বেশি। যদিও আধুনিক কালে প্রতিবাদী সাহিত্যিকেরাও এসেছেন।


সাধারণভাবে লেখা অনেক উপন্যাসেই তৎকালীন সমাজ, রাষ্ট্রনীতি অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। কিন্তু যখন শ্রেণীবিভাগের জন্য উপন্যাস বিচার করতে হয়, তখন একটি বিশেষ সামাজিক সমস্যা তার প্রধান উপজীব্য কিনা, যে চরিত্রগুলি উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে তারা সেই সামাজিক সমস্যা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিনা তাও দেখা আবশ্যক। কিংসলের 'ইস্ট', ডিকেন্সের ‘হার্ড টাইম্স’, মেরীস্টোর 'আঙ্কেল টমাস কেবিন', বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল', রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ তারাশঙ্করের ‘শহরতলী’ রমাপদ চৌধুরীর 'আকাশ প্রদীপ' প্রভৃতি সার্থক সামাজিক উপন্যাসের দৃষ্টান্ত হতে পারে।


শরৎচন্দ্র বাঙালী পরিবার ও সামাজিক জীবনের সার্থক রূপকার। তাঁর সমস্ত উপন্যাসেই রচিত হয়েছে সামাজিক পটভূমিতে। ‘পল্লীসমাজ' শরৎচন্দ্রের একটি সার্থক সামাজিক উপন্যাস। শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসেই নর-নারীর প্রেমঘটিত সমস্যা প্রাধান্য পায়। পল্লীসমাজেও তেমনি একটি প্রেমকাহিনী আছে। কিন্তু সমাজের প্রবল আলোড়নে তা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বিদেশে বড় হওয়া রমেশ পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেকদিন পরে গ্রামে ফিরে এসেছে। গ্রাম সম্পর্কে অনেক রোমান্টিক ধারণা ছিল রমেশের। গ্রামোন্নয়নের অনেক পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু গ্রামে ফিরে জ্ঞাতিশত্রু বেণীঘোষাল ও সহচর মাতব্বর ব্রাহ্মণ শ্রেণীর চক্রান্তে জেলে যেতে হল রমেশকে। গ্রাম সম্পর্কে রমেশের সমস্ত মোহই প্রায় ভেঙে গেল। জেল থেকে ফিরে গ্রাম ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত যখন প্রায় পাকা করে ফেলেছে তখন গ্রামের লোকেরা তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় সমস্যা নিঃসন্দেহে সামাজিক সমস্যা কেন্দ্রিক। ‘পল্লীসমাজ’ গ্রাম বাংলার দারিদ্র্য শোষণে জর্জরিত জীবনের দলীল স্বরূপ। শোষণের স্বীকার হতে হতে মানুষের সং উদ্দেশ্যকেও তারা বিশ্বাস করে না। বিবেক বর্জন দিয়ে নিজেদের সামান্যতম লাভও তারা উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করে। গ্রাম সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতা রমেশের কাছে যখন তিক্ত তখন গ্রামেরই এক অসাধারণ সহিলা জ্যাঠাইমা তাকে বলেছে, সমস্যাটিকে গভীরভাবে ভিতর থেকে দেখতে। বাইরে থেকে অগভীর ভাবে দেখলে মানুষের স্বার্থপরতা এবং নীচ দলাদলিই শুধু চোখে পড়ে। কিন্তু সমস্যাকে বিচার করতে হবে তাদেরই একজন হয়ে। আর তখনই বোঝা যাবে এই সমস্যার প্রধান কারণ দুটি অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শিক্ষার অভাব। অর্থনৈতিক সমস্যা চরমে ওঠাতেই মানুষের বিবেকবোধ লোপ পেয়েছে। জ্যাঠাইমা রমেশকে বুঝিয়েছেন—


“এরা যে কত দুঃখী, কত দুর্বল- তা যদি জানিস রমেশ, এদের উপর রাগ করতে তোর লজ্জা হবে।”


শিক্ষার অভাবের কথাও বলেছেন—

“আলো জ্বেলে দেরে, শুধু আলো জ্বেলে দে। গ্রামে গ্রামে লোক অন্ধকারে কানা হয়ে গেল, একবার কেবল তাদের চোখমেলে দেখবার উপায় করে দে বাবা। তখনি দেখতে পাবে তারা কোনটা কালো, কোনটা আলো।"


গোটা উপন্যাসই এই সামাজিক সমস্যায় আন্দোলিত। রমা ও রমেশের জটিল প্রেমের গভীরতা সামাজিক সমস্যার স্রোতে ভেসে গেছে। উপন্যাসের ঘটনা, চরিত্র, সবেরই নিয়ন্ত্রক এ উপন্যাস সমাজে। পল্লীসমাজ একটি নিখুঁত সামাজিক উপন্যাস।