চন্দ্রশেখর উপন্যাসের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে রাত্রির প্রেক্ষাপটে —এইরকম তিনটি ঘটনা অবলম্বনে বিশ্লেষণ করে দেখাও রাত্রির ব্যবহার উপন্যাসে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।

উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর মানসলোক উদ্ঘাটনে প্রকৃতি বর্ণনা একান্ত বাঞ্ছনীয়। প্রকৃতির সংকেতময়তা ফুটে ওঠে চরিত্রের অন্তর্লোকের রহস্য। কাজেই মানসজগতকে যথাযথভাবে রূপ দিতে গেলে প্রকৃতির জগতের দ্বারস্ত হতে হয়। চন্দ্রশেখর-এর মধ্যে ঐতিহাসিক উপাদান যথাযথভাবে সংস্থাপিত হলেও তবে তা মূল ঘটনা বহির্ভূত। মূল ঘটনার চরিত্রগুলি অনৈতিহাসিক। তাঁদের মানসলোকের চিত্র উপন্যাস মধ্যে স্বতোৎসারিত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাই চন্দ্রশেখর ঐতিহাসিক উপন্যাসরূপে বিবেচিত না হয়ে, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক ভাবেই উপন্যাস মধ্যে প্রকৃতি একটা বড়ো স্থান দখল করে নিয়েছে। তবে উপন্যাস মধ্যে যে প্রকৃতি কেন্দ্রিভূত হয়েছে তা গঙ্গা নদীকে উপজীব্য করে। সে প্রকৃতি চরিত্রে মানসলোকের চিত্র পরিস্ফুটনের বিশেষ সহায়ক হলেও বেশ কয়েকটি রাত্রির দৃশ্য উপন্যাস মধ্যে এমনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তাকে প্রকৃতি রূপে আখ্যাত না করে কাল বা সময়রূপে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। রাত্রির এই দৃশ্যের সঙ্গে প্রকৃতির কোনো নিগৃহ সংযোগ অনুভূত হয় না। কেবলমাত্র ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক ঘটনার গাম্ভীর্যতাকে ফুটিয়ে তুলতে লেখক সুকৌশলে উপন্যাসমধ্যে বেশ কয়েকটি রাত্রির দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু এখানকার রাত্রির দৃশ্যগুলি ঘটনার উত্থানপতনে অতি সহজেই বিশিষ্টতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। প্রশ্নানুযায়ী রাত্রির দৃশ্য উদ্ঘাটন করে তিনটি প্রধান ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রথমত, দলনী বেগম নবাবের বিপদাশংকায় গুরগনের নিকট যাত্রা করেছিলেন রাতের অন্ধকারে কেবলমাত্র কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে। সেই রাতেই তিনি গুরগনের নিকট উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে গুরগনের প্ররোচনায় দূর্গমধ্যে প্রবেশের অধিকার হারিয়ে রাজপথে বিচরণ করেছিলেন। ব্রষ্মচারী চন্দ্রশেখরের সাহায্যে তাঁরা প্রতাপের গৃহে ঠাঁই পেলেও রাজনৈতিক অরাজকতা তাঁকে স্থির হতে দেয়নি। শৈবালিনী ভ্রমে ধৃত হয়ে তিনি সেই রাতে ইংরাজদের নৌকাতে আনিতা হয়েছিলেন। অর্থাৎ যে রাত্রেই তিনি অন্তপুর থেকে বাইরে এসেছিলেন সেই রাত্রেই অপহূতা হয়ে কলংকের ডালি মাথায় নিয়ে তিনি সুন্দর সুখী জীবন থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে মৃত্যুপথে ধাবিত হলেন। রাত্রিই যেন তাঁর জীবনকে আঁধারে ভরিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে রাত্রির অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।


বেদগ্রামে স্বামীগৃহ হতে শৈবালিনী লরেন্স ফষ্টর কর্তৃক অপহূতা হয়েছিলেন এই রাত্রিকালীন সময়ে। সে রাত্রে গ্রামের সবাই বুঝলেন শৈবালিনীকে দস্যুরা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে, কিন্তু শৈবালিনী জানেন তিনি স্বেচ্ছায় কুলত্যাগিনী হয়েছেন। সে রাত্রে ইংরাজ নৌকাতে শৈবালিনী চলেছিলেন মুঙ্গেরের উদ্দেশ্যে। পরদিন রাত্রে সুন্দরীর দ্বারা সংবাদপ্রাপ্ত হয়ে প্রতাপ যাত্রা করেছিলেন শৈবালিনী উদ্ধারে। প্রবল বিক্রমে কতিপয় ইংরাজ সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করে তিনি শৈবালিনীকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। শৈবালিনী জানে না কে তাঁকে উদ্ধার করলো, প্রতাপ জানলেন তাঁর প্রেমাস্পদকে বিধর্মীদের দ্বারা কলঙ্কিত হতে দেননি। অতঃপর নিজের গৃহে নিজের শয্যাতে পূর্বপ্রণয়ী শৈবালিনীকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে প্রতাপের চিত্রলোক আন্দোলিত হল– “অনেক দিনের কথা তাঁহার মনে পড়িল। অকস্মাৎ স্মৃতিসাগর মহিত হইয়া তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ প্রহত হইতে লাগিল।” কিন্তু প্রতাপের এই বিহ্বলতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। যখন তিনি জানলেন তাঁরই জন্য শৈবালিনী এমনভাবে কুলত্যাগিনী হয়েছিলেন, তখন– “প্রতাপের মাথায় বজ্ৰ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তিনি বৃশ্চিক দষ্টের ন্যায় পীড়িত হইয়া, সে স্থান হইতে বেগে পলায়ন করিলেন।” তবে প্রতাপ শৈবালিনীকে মুক্ত করেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। সামান্য অসতর্কতার জন্য ইংরাজ সৈন্য আহত বকাউল্লা খাঁ তাঁদের গোপন ডেরার সংবাদ জেনে গিয়ে ইংরাজদের জানিয়ে দেন। সেই রাতেই ইংরাজ সায়েব গলষ্টন জনসন সৈন্য নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে নিরস্ত্র প্রতাপকে বন্দি করেন এবং কোলকাতায় তার বিচারের জন্য প্রেরণ করেন। অতএব উপন্যাসমধ্যে রাতের ভূমিকাকে একেবারেই অগ্রাহ্য করার নয়।


ইংরাজরা প্রতাপকে বন্দি করে নিয়ে গেলে শৈবালিনী থেমে থাকলেন না। কৌশলের দ্বারা নবাব মীরকাসেমের নিকট হাজির হয়ে নিজেকে রূপসী রূপে পরিচয় দিয়ে স্বামী প্রতাপকে উদ্ধারের জন্য সাহায্য কামনা করলেন। নবাব তাঁর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শৈবালিনী ধাবিত হলেন প্রতাপকে উদ্ধারের জন্য। সময়টা ছিল জ্যোৎস্নারাত্রি। অনাথিনীর ছদ্মবেশে গভীর কান্নায় আপ্লুত হয়ে তিনি ইংরাজ নৌকায় উঠতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং ব্রাহ্মণের অন্ন খাওয়ার অপেক্ষায় তিনি প্রতাপকে মুক্ত করে গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দেন এবং পলায়নে সমর্থ হন। এখানকার বর্ণনায় পাই– “দুজনে সাঁতারিয়া অনেক দূরে গেল। কী মনোহর দৃশ্য! কী সুখের সাগরে সাঁতার! এই অনন্ত দেশব্যাপিনী, বিশাল হৃদয়া, ক্ষুদ্র বিচিমালিনী, নীলিময়ী তটিনীর বক্ষে, চন্দ্রকর সাগরমধ্যে ভাসিতে ভাসিতে, সেই সুদূর অনন্ত নীল সাগরে দৃষ্টি পড়িল।” উভয়ে সন্তরণকালে যা কথা হয়েছিল তার সারমর্ম হল প্রতাপকে ইহজীবনে ভুলে থাকা শৈবালিনীর পক্ষে অসম্ভব। তথাপি প্রতাপের জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন– “আজি হইতে তোমাকে ভুলিব। আজি হইতে আমার সর্বসুখে জলাঞ্জলি। আজি হইতে আমি মনকে দমন করিব। আজি হইতে শৈবালিনী মরিল।” কথা রাখতে সেই রাতেই নৌকা প্রতাপকে না জানিয়ে নদীতীরস্থ অরণ্যমধ্যে আত্মগোপন করেছিলেন। জীবনের পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণে হয়তো তাঁর এমনভাবে পলায়ন। কিন্তু শৈবালিনীর জীবন যে রাতের আধারের মতো গাঢ় কালিমায় লিপ্ত তা বলা বাহুল্য।


এসকল পর্যালোচনায় এটুকুই বোঝা গেল চরিত্রের জীবনের দুঃখময় ও করুণতম চিত্র উদ্‌ঘাটিত হয়েছে রাত্রির দৃশ্যেই। কোন সুখময় চিত্র উপন্যাসমধ্যে রাত্রির আঁধারে উদ্ঘাটিত হয়নি। লেখক বোধ করি রাত্রির গাঢ় কালিমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিশেষ বিশেষ দুঃখজনক ঘটনাগুলি রাত্রিতেই সংঘটিত করেছেন। তবে তিনি সার্থকও হয়েছেন। রাত্রি দৃশ্যগুলি উপন্যাসমধ্যে বিশেষ চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করে পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছে। তাইতো রাত্রির দৃশ্য পৃথকভাবে আলোচনার দাগ রেখেছে।