দলনীর চক্ষু হইতে ক্রোধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। সেই ক্ষুদ্র দেহ উন্নত করিয়া এছতা দাঁড়াইয়া দলনী বলিলেন– 'সে তোমার মতো পাপিষ্ঠের কাছে প্রাণ দান গ্রহণ করে সে তোমার অপেক্ষাও অধম– বিষ আন।'— দলনী কাকে কেন পাপিষ্ঠা শিন বলেছিল? এই উক্তির আলোকে দলনীর চরিত্রবৈশিষ্ট্য ও ভাগ্যবিড়ম্বিত তব জীবনবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করো।

দলনী পাপী বলেছিলেন তকি খাঁকে। তকি খাঁ দলনীকে উদ্ধার করতে গিয়ে ইংরাজ সায়েবদের যুদ্ধে হত্যা করেও যখন দলনীর সন্ধান পেলেন না তখন তিনি নবাবের নিকট মহত্ব জাহির করতে মিথ্যার আশ্রয় নেন। নবাবকে পত্রমারফৎ জানালেন– দলনী সম্প্রতি অমিয়টের অঙ্কশায়িনী, নবাবের নিকট ফিরতে নারাজ। নবাব প্রিয়তম পত্নীর এই ব্যাভিচারিতার বিচারবুদ্ধিতে অন্ধ হয়ে গেলেন, এবং ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নির্দেশ দিলেন দলনীকে বিষপানে হত্যার। তকি খাঁর আসক্তি ছিল দলনীর প্রতি। তিনি দলনীকে জানালেন মৃতুদণ্ড তখনি রদ হতে পারে দলনী যদি তকি খাঁকে গ্রহণ করেন। তকি খাঁর এই বক্তব্যে দলনী তকিকে ধিক্কার দিতে উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছেন।


নবাব মীরকাসেমের প্রিয়তমা পত্নী দৌলতউন্নেষা বেগম দলনী নামেই তিনি পরিচিতা। ‘চন্দ্রশেখর' উপন্যাসের উপকাহিনির নায়িকা দলনী। অনিন্দ্য রূপসৌন্দর্য্যের প্রতিমা তিনি, তাঁর গুণের তুলনা হয় না। তাঁকে প্রথম দেখা যায় মুঙ্গের দূর্গের রংমহলে। এক লজ্জানম্র ভীরু নারী, নবাবের অন্তঃপুরে রূপের তরঙ্গ তুলে বেড়াচ্ছেন—কখনো বীণাবাদনে কখনো সঙ্গীতে নিরতা। অদৃষ্ট দেবতা এ হেন একটি প্রেমমুগ্ধা বালিকার ভাগ্যকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলেছেন— তাঁর দৈবাহত জীবনের পরিণাম সত্যই মর্মান্তিক। নিয়তি তাঁকে রাজপুরী হতে রাজপথের মধ্যে টেনে এনেছেন। পথে প্রান্তরে ঘুরে মরেছে, শেষে তাঁকে করাল মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করে তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনের ওপর যবনিকা টেনে দিয়েছেন।


দলনী কীভাবে ইস্পাহাস থেকে এসে ভাগ্যান্বেষণ সূত্রে নবাব হারেমে বাঁদীরূপে প্রবেশ করেছিলেন। কী প্রকারে পরে তিনি বেগমের মর্যাদা লাভ করেছেন তা জানবার কোনো পথ নেই। তবে অনুমান করা চলে, তাঁর রূপশোভা, চারিত্রিক সরলতা আর কোমল স্বভাবের গুণে মুগ্ধ হয়ে নবাবই তাঁকে বেগমরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। সাধারণত যে ছলাকলার মাদকতা ছড়িয়ে পুরুষের চিত্ত জয় করতে হয় তা দলনীর মতো নারীর পক্ষে আদৌ সম্ভবপর বলে মনে হয় না। নবাব তাঁকে টেনেছেন, তবে তিনি নবাবের কাছে ধরা দিয়েছেন। বাঁদী দলনী হলেন বেগম।


দলনী স্বভাবত সাহসিনী নয়। কিন্তু পরিচারিকা কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে রাত্রিকালে দূর্গের বাইরে সেনাধ্যক্ষ গুরগনের সঙ্গে দেখা করার মতো দুঃসাহস তিনি করেছেন। প্রেমের বীর্যে তিনি অশঙ্কিনী। ইংরাজের সঙ্গে স্বামীর সমূহ বিপদ বুঝে তিনি গুরগনের সাহায্যপ্রার্থিনী হয়েছিলেন। যখন স্বার্থাল্ব, বিশ্বাসঘাতক গুরগনের চক্রান্তে তাঁর দূর্গ প্রবেশের পথ বন্ধ হয়েছে, ধরা পড়লে যখন চরম শাস্তি হতে পারে তখনো দলনী পলায়নের কথা ভাবেননি। স্বামীর নিকট হতে পালিয়ে তিনি কোথায় যাবেন, স্বামীবিহনে তাঁর নারীজীবনই যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ - নিরর্থক। তাই নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডাদেশকেও তিনি অবলীলায় উপেক্ষা করলেন। যখন ফক্টরের নৌকা হতে নির্জন নদীতীরে তিনি নেমে পড়লেন, যখন অপরিচিত আগত্তুকের মুখে শুনলেন, মুঙ্গেরে গেলে তাঁর মহা বিপদপাতের সম্ভাবনা, তখনো তিনি সেই কথায় কর্ণপাত করেননি। স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ততখানি তাঁর মানস উৎকণ্ঠা। নবাবের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় এতটুকু ফাঁক ছিল না। দলনীর সুগভীর বিশ্বাস ছিল, নবাব তাঁর প্রেমে কদাপি সংশয় প্রকাশ করতে পারবেন না; নবাবও যে তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন— সুতরাং, নবাবের ক্ষমা তিনি পারেনই।


দলনীর ন্যায় কোমলহ্দয়া রমণীর চরিত্রে তেজস্বিতা প্রকাশের তেমন কোনো অবকাশ থাকে না। কিন্তু তাঁর পাতিব্রত্য যখন নিন্দিত হয়েছে, তাঁর সতীত্ব যখন ব্যাঙ্গের দ্বারা ধিকৃত হয়েছে, তখন তিনি গর্জে উঠেছেন। বিপক্ষে যেই থাকুক তিনি তাঁকে তৃণবৎ তুচ্ছ করেছেন। চক্রান্তধারী গুরগন যখন তাঁকে দ্বিতীয় নলরজাহান হতে পরামর্শ দিল তখন তিনি আত্মহারা হয়ে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। আবার, তকি খাঁ যখন তাঁকে কু প্রস্তাব দিল তিনি নিদারুণ রোষে তকি খাঁকে পদাঘাত করলেন। সাংসারিক অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না, থাকলেও ফলাফলের কথা না ভেবে অবশ্যই তিনি এরূপ আচরণ করতেন। প্রেমের অবমাননা মুখ বুজে সহ্য করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সতীত্বের প্রশ্নে তিনি রৌদ্রমূর্তি প্রকাশ করেন।


স্বামী অনুরাগিনী দলনীর মৃত্যু বড়োই মর্মস্পর্শী। অজস্র বিপদ অতিক্রম করে যখন তিনি নবাবের নিশ্চিত আশ্রয় লাভের আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন, আঁধারের পারে যখন আলোকের রেখা দেখা যাচ্ছে তখনই অভাবনীয় মৃত্যু এসে তাঁকে গ্রাস করলো। তকির ষড়যন্ত্রে এমনটি ঘটল। বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হোক নবাব এরূপ আদেশ দেবেন তা প্রথমে দলনী বিশ্বাস করতে পারেননি। পরে যখন বুঝলেন, সত্যসত্যই নবাব তাঁকে মৃত্যু আজ্ঞা দিয়েছেন তখন তিনি স্বেচ্ছায় বিষপান করলেন। এই মৃত্যুর দৃশ্যটি কী করুণ। এ হেন এক ভয়ঙ্কর মুহূর্তে কী স্নিগ্ধ তাঁর মূর্তিটি। বিষপাত্রে চুমুক দিয়ে ভূমিতলে তিনি লুটিয়ে পড়লেন, কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন- “রাজরাজেশ্বর, এ গরীব দাসীর ওপর কী হুকুম দিয়াছ? বিষ খাইব? তুমি হুকুম দিলে কেন খাইব না? তোমার আদরই তো আমার অমৃত তোমার ক্রোধই আমার বিষ। তুমি যখন রাগ করিয়াছ আমি বিষপান করিয়াছি। ইহার অপেক্ষা বিষে কি অধিক যন্ত্রণা? ...আমি তোমার আদেশে বিষপান করিব, কিন্তু তুমি দাঁড়াইয়া দেখিলে না—এই আমার দুঃখ।” অর্থাৎ দৈবরোষে ভরা বসন্তে চিত্ত বিমোহন একটি ফুল মাটির ধুলায় ঝরে পড়ল—মীরকাসেমের বেগম দৌলতউন্নিসা আত্মহত্যা করলেন, নবাব তাঁকে বিশ্বাস করতে পারলেন না, অপরের প্রচারিত মিথ্যা কুসাকেই নিত্যসত্য বলে মনে করলেন, এই বেদনা বুকে নিয়ে দলনী মরলেন। এটাই দলনীর জীবনের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি।