“চন্দ্রশেখর উপন্যাসে নদী ও মানব জীবনের সংযোগ রচিত হয়েছে।”–বিশ্লেষণের সাহায্যে এই বিষয়ে তোমার অমিত প্রতিষ্ঠা করো।

প্রত্যেকটি মানুষের জীবন খরস্রোতা নদীর মতো। পাহাড়পর্বত খরস্রোতা বন্ধুর পথ অতিক্রম করে যেমন নদী সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হয়, প্রতিটি মানুষ তেমন সুখ-দুঃখ ব্যথাবেদনা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জীবনের শেষ অধ্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়। সমালোচ্য ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের চরিত্রগুলিও নদীর ধারার মতো প্রতিভাত হয়েছে। নানান উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জীবন ধারণ করেছে অবশেষে তারা এক সুষ্ঠু সমাধানে পর্যবসিত হয়েছে। নদীর সঙ্গে এ উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর বিশেষ সাদ্যশ্য অনুভূত হয় বলেই বোধ হয় লেখক সুকৌশলে ব্যাপক রূপে নদীর কথা এখানে উত্থাপিত করেছেন। যেখানে প্রতিমুহূর্তে নদীর সঙ্গে মানবজীবনের সংযোগ রচিত হয়েছে।


উপন্যাসের উপক্রমণিকা অংশে দেখা যায়, প্রতাপ-শৈবালিনী বাল্য হতেই ভাগীরথী নদীর তীরে একসাথে খেলাধুলা করে বড়ো হয়েছে, ক্রমশ কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করে গভীর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়েছেন। সামাজিক কারণে তাঁদের বিবাহ অনিশ্চিত জেনে তাঁরা এই গঙ্গাবক্ষেই ডুবে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে উপন্যাসের সূচনা অংশে উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদীও সমানভাবে এগিয়ে চলেছে, যে নদীর স্রোতোধারার সঙ্গে পাত্রপাত্রীর জীবনধারার হুবহু সাদৃশ্য প্রত্যক্ষিত হয়। অর্থাৎ তাঁরা একার্থে নদীর ধারার মতো।


চন্দ্রশেখর ব্রহ্মচর্য ব্রত ত্যাগ করে শৈবালিনীর প্রতি যে মোহমুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাও সম্ভব হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে। প্রতাপ শৈবালিনীকে ডুবতে দেখে চন্দ্রশেখর নৌকাযোগে ধেয়ে গিয়েছিলেন তাদের উদ্ধার করতে। প্রতাপকে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন। এইসময় তিনি সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন শৈবালিনীর। অর্থাৎ চন্দ্রশেখর ও শৈবালিনীর যোগসূত্র রচনা করেছে নদী।


রাতের অন্ধকারে অপহূতা হয়ে শৈবালিনী নৌকাযোগে নদীপথে কষ্টরের সঙ্গে চলেছিলেন মুঙ্গেরে। সুন্দরী তাঁকে উদ্ধার করতে এলেও তিনি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, অবশেষে প্রতাপ সদলবলে এসে ইংরাজদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শৈবালিনীকে এই নদীর ওপর ভাসমান নৌকা হতে উদ্ধার করে নিয়ে যান। পরে নিজের অজান্তেই প্রতাপ ইংরাজ কর্তৃক ধৃত হয়ে তাঁর অপরাধের বিচারের জন্য নৌকাযোগে কলিকাতা যাত্রা করেছিলেন। শৈবালিনীও আপন বুদ্ধিমত্তায় নবাবের সহায়তায় প্রতাপকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এই নদীবক্ষেই কৌশলে শৈবালিনী প্রতাপকে নিয়ে নৌকা হতে জলে ঝাঁপ দিয়ে পলায়ন করেছিলেন। একসময় প্রতাপ শৈবালিনী নদীতে সাঁতার দিয়েছিলেন ডুবে মরার জন্য। এবার তাঁরা সাঁতার দিলেন উদ্ধারের জন্য। তবে শৈবালিনী প্রতাপকে নিয়ে দ্বিতীয় সাঁতার দেওয়াকালীন বুঝলেন– প্রতাপ ভিন্ন তার ইহজগতে অন্য কোনো সুখ নেই। প্রথম তাঁরা নদীতে সাঁতার কেটেছিলো আশাভঙ্গের কারণে তখন তাঁরা অবিবাহিত। দ্বিতীয়বার তাঁরা সাঁতার কাটলেন বাঁচার জন্য। এবার তাঁরা বিবাহিত। শৈবালিনী চন্দ্রশেখরের পরিণীতা, আর প্রতাপ রূপসীর স্বামী। এমনিভাবেই নদীবক্ষেই আবর্তিত হয়েছে প্রতাপ শৈবালিনীর স্বামী।


নবাবের মঙ্গলকামনায় তাঁর উপপত্নী দলনী বেগম অন্তঃপুর থেকে নেমে এসেছিলেন রাজপথে। রাতের অন্ধকারে গুরগন খাঁর সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে তাঁর আর দূর্গমধ্যে ফেরা হয়নি। নিরাপত্তা হেতু ব্রহ্মচারীর নির্দেশমতো তিনি প্রতাপের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাতেই শৈবালিনী ভ্রমে তিনি ইংরাজদের নিকট বন্দিনী হয়ে গঙ্গাবক্ষে নৌকার মধ্যে অবস্থান করছিলেন। এই দুঃসংবাদে নবাব অস্থির হয়ে পড়েন এবং তকি খাঁকে নির্দেশ দেন, দলনী বেগমকে উদ্ধার করতে। তকি খাঁ সসৈন্যে দলনীকে উদ্ধার করতে এসে ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই নদীবক্ষেই। যুদ্ধে অমিয়ট জনসন সাহেবের মৃত্যু হল বটে কিন্তু দলনীকে পাওয়া গেল না। দলনী তখন ফষ্টরের নৌকা করে যুদ্ধের সীমানার বাইরে অবস্থান করছেন। পরে অবশ্য দলনী ব্রষ্মচারী কর্তৃক মুর্শিদাবাদে এলেও, সুখের সূর্য তাঁর ভাগ্যে আর উদিত হয়নি। নবাবের নির্দেশমতো কলঙ্কিনী নাম ঘোঁচাতে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।


তাহলে এ যাবৎ দেখা গেল উপন্যাসের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলি সংঘটিত হয়েছে নদীবক্ষেই। নদী ছাড়া যেন এ উপন্যাসের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এর ঘটনাগুলি যেমন নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে অনুরূপ এর চরিত্রগুলিও নদীর ধারার মতো কেন্দ্রিভূ ত হয়েছে। প্রতাপ যথার্থ প্রেমিক পুরুষ। বাল্য হতে শৈবালিনীকে ভালোবেসে এলেও তাঁরা শুভপরিণয়ে আবদ্ধ হতে পারেননি সামাজিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। শৈবালিনীকে ইহজীবনে পাওয়া হবে না বলে তিনি ডুবে মরতে গিয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্রশেখরের বদান্যতায় প্রাণ ফিরে পান। হয়তো রূপসীকে বিবাহের পর তিনি সুখী সংসারী হতেন, কিন্তু শৈবালিনীর চিন্তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। শৈবালিনীর উদ্ধারকার্যে নিজেকে নিয়োগ করে, শেষে শৈবালিনীর জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে তিনি স্বেচ্ছায় রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে জীবনের অস্তিপরিণতি বিঘোষিত করেন, প্রতাপের এ জীবন নদীর স্রোতের মতোই। শৈবালিনীও অনুরূপ, তিনি জীবনকে ভালোবেসে প্রতাপের সঙ্গে ডুবে মরতে গিয়েও যখন ফিরে এলেন তখন তার মধ্যেই সূচিত হয়েছিল তিনি সুখীজীবনের অধিকারী নন। শেষে নিজের জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে প্রেমাস্পদ প্রতাপকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। এর জীবনও তো বৈচিত্র্যময় নদীর স্রোতের মতো। চন্দ্রশেখর দলনী প্রভৃতি চরিত্রই এই বৈশিষ্ট্যে সমাসীন। তাই উপন্যাসমধ্যে নদী ও মানবজীবনের যে গভীর সংযোগ অনুভূত হবে তাতে আর বিচিত্র কী?