শ্রীকান্ত উপন্যাসের গঠন শৈলী সম্পর্কে আলােচনা করাে।

শ্রীকান্ত উপন্যাসের গঠন শৈলী

‘শ্রীকান্ত' লেখকের সময় শরৎচন্দ্র বােধ কবি প্লট সম্পর্কে বিশেষ চিন্তাকুল ছিলেন না। নইলে ভারতবর্ষের পাতায় শ্রীকান্ত শর্মা লিখতেন না—শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনি। তবে এ ভ্রমণ-কাহিনি গাড়ি পাল্কী চেপে লােকলস্কর সমভিব্যবহারে ভ্রমণের ফল নয়, এ হল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লন্ধ সচেতন সাহিত্যিকের সৃষ্টি। ভ্রমণ-সাহিত্য রচনা করবার ইচ্ছা থাকায় শরৎচন্দ্র বােধ হয় শ্রীকান্তে গল্প কথনের একটি বিশেষ ভঙ্গ গ্রহণ করেছিলেন। স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে প্রথমেই যাকে স্মরণ করেছেন তার কথা আগে লিখেছেন। এইভাবে কল্পনায় এসেছে- ইন্দ্রনাথ, অন্নদাদি, শাহজী, মেজদা, নতুনদা, নিরুদি, গৌরী তেওয়ারীর মেয়ে। সন্ন্যাসী, বা রাজলক্ষ্মী প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে ভবঘুরে শ্রীকান্ত বিভিন্ন স্থান পরিক্রমা করে উপন্যাসের স্থানকালের সুচিহ্নিত সীমাকে দ্রুত উল্লংঘন করেছে। ফলে উপন্যাসের গতি হয়েছে কিছুটা শ্লথ, ঘটেছে প্রসঙ্গচ্যুতি এবং রহস্য মমতার অভাব। এইজন্য সমালােচকেরা শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্লটকে শিথিল—সংবদ্ধ প্লট আখ্যা দেন।


মােটের ওপর বলা যায়, 'শ্রীকান্ত—১ম খণ্ড' এর প্লট গঠন অনেকটা যৌগিক প্লটের মতাে। কারণ, প্রথম খণ্ডের সমগ্রত জুড়ে বসেছে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নানান ঘটনার সমাবেশ। উপন্যাসের বিভিন্ন পরিচ্ছেদের ঘটনাগুলি এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে-


প্রথম পরিচ্ছেদে আছে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের পরিচয়, পিসেমশায়ের বাড়িতে শ্রীকান্তকে পাঠাভ্যাস প্রসঙ্গে মেজদা কাহিনি, শ্রীনাথ বহুরূপীর কাহিনি এইসব। এই পরিচ্ছেদে লেখক মূলত ইন্দ্রনাথ চরিত্রকেই উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের নৈশ অভিযান। তৃতীয় পরিচ্ছেদে মাছ চুরি করে ফেরা এবং মৃতদেহের সামনে পড়ে মৃতদেহ সম্পর্কে ইন্দ্রনাথের কিছু বক্তব্য এবং শ্রীকান্তের মনােভাব বর্ণিত।


চতুর্থ পরিচ্ছেদে শ্রীকান্তের নৈশ অভিযানের ফলস্বরূপ শাস্তিদানের জন্য মেজদার পুনর্বিভাব এবং ইন্দ্রনাথের হাত ধরে অন্নদাদিদির সাথে শ্রীকান্তের পরিচয়।


পঞ্চম পরিচ্ছেদে অন্নদাদিদি ও শাহুজীর কাহিনি। যষ্ঠ পরিচ্ছেদে সখের থিয়েটারে অভিনয়ের হাস্য রসাত্মক বর্ণনা এবং সেখান থেকে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে অন্নদাদিদির বাড়িতে যাত্রা। এই পরিচ্ছেদের শেষে অন্নদাদিদির দেওয়া একটি চিঠির উল্লেখ যা অন্নদা চরিত্রটিকে শ্রীকান্তের মতােই পাঠকের কাছেও স্পষ্ট করে দেয়।


সপ্তম পরিচ্ছেদে নতুনদাদার হাস্যরসাত্মক কাহিনির বর্ণনা।


অষ্টম পরিচ্ছেদে পিয়ারী বাঈজী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে শ্রীকান্তের সাক্ষাৎ এবং শ্মশানের অনুপম বর্ণনা।


নবম পরিচ্ছেদে শ্রীকান্তের বিভিন্ন চিন্তাগুলির মূলত বর্ণিত। শ্মশানে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতার বর্ণনা, রমণীহৃদয়ের বিশ্লেষণ এবং আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু ভাবনা।


দশম পরিচ্ছেদে নিজের অজান্তে শ্রীকান্তের শ্মশান যাত্রা এবং পিয়ারীর ভৃত্য রতন কর্তৃক ভাবাবিষ্ট শ্রীকান্তকে ফিরে আসার কথা। আবার এই পরিচ্ছেদেই শ্রীকান্ত দেশে ফিরে যেতে রাজী হয়েছে রাজলক্ষ্মীর অনুরােধে।


একাদশ পরিচ্ছেদে সন্ন্যাসী জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনা এবং তেওয়ারী কন্যার কাহিনি যুক্ত হয়েছে। শেষের দিকে ভবঘুরে শ্রীকান্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে।


দ্বাদশ পরিচ্ছেদে শ্রীকান্ত ও পিয়ারীর পুনর্মিলন এবং পিয়ারীর সেবায় সুস্থ হয়ে শ্রীকান্তের প্রত্যাগমন-রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তের বিচ্ছেদ। এখানেই শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে সমাপ্তি ঘােষিত হয়েছে।


উপন্যাসের এই সামগ্রিক নাবিন্যাস পর্যালােচনায় মনে পড়ে যায় লেখকের সেই অকপট স্বীকারােক্তির কথা— “লিখিতে বসিয়া আমি অনেক সময়ই আশ্চর্য হইয়া ভাবি, এইসব এলােমেলাে ঘটনা আমার মনের মধ্যে এমন করিয়া পরিপাটিভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছিল কে? যেমন করিয়া বলি তেমন করিয়া তাহারা একটির পর একটি সুশৃঙ্খলিত হইয়া ঘটে নাই।” অর্থাৎ ঘটনগুলির খানিকটা এলােমেলাে মনে হলেও দেখা যায় প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে সপ্তম পরিচ্ছেদে পর্যন্ত প্রত্যেকটি ঘটনা বা চরিত্রই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে এই পরিচ্ছেদগুলির প্রধান চরিত্র ইন্দ্রনাথ অথবা শ্রীকান্তের দ্বারা। যেমন, শুরুতেই যে মেজদার কাহিনি লেখক অবতারণ করেছেন সেখানে ইন্দ্রনাথের নাটকীয় উপস্থিতি লক্ষিত। আর ইন্দ্রনাথকে লেখক পরবর্তীকালে যেভাবে উপস্থিতি করেছেন। তাও কিছুটা আভাসিত হয়ে ওঠে হৈ হট্টগােলের মধ্যে ইন্দ্রনাথের এক ঝলক উপস্থিতির। আবার অন্নদাদিদির শাহূজীতে ঘটনাও ইন্দ্রনাথের হাত ধরেই শ্রীকান্তের সঙ্গে যুক্ত। এইভাবেই ক্ৰমিক পরম্পরায় এসেছে নতুন দাদা রাজলক্ষ্মী, গৌরী তেওয়ারীর মেয়ে প্রভৃতি চরিত্র। ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্ন মনে হলেও একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কন্বিত।


মূলত শ্রীকান্তের ভবঘুরে জীবনের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা, সুখ বা দুঃখ প্রেম বা প্রত্যয়গুলিকে ব্যাখ্যা করাই শরৎচন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল। ভবঘুরে শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের কাছে শিখেছে স্বার্থত্যাগের আনন্দ, উদাসী হওয়ার একান্ত আকুলতা, গভীর মমত্ববােধ এবং দুঃসাহসিকতা। অন্নদাদিদি শ্রীকান্তের তরুণ মনে যে মঙ্গলমূর্তি স্থাপন করলেন, যে স্নেহের আলপনা অঙ্গন করলেন, উত্তরকালে ওই কল্যাণীমূর্তি শ্রীকান্তকে আরও মহৎ জীবনের কর্মপ্রেরণার উৎসাহ দান করল। এরপর কুমার সাহেবের আমন্ত্রণ পিয়ারী বাঈজীর দর্শন। পরশপাথরের স্পর্শে লােহাও সােনা হয়, শ্রীকান্তের কাছে তাই বাঈজী ধরা দিল রাজলক্ষ্মী রূপে। শ্রীকান্ত এখন তরুণ, সে অনুভব করল-বড়াে প্রেমের অস্তিত্ব, যা 'শুভকর্ম পথে মহা নির্ভয় গান' রচনা করে। এভাবে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃত্তে শ্রীকান্তের ১ম পর্ব একটি সুবলয়িত কাহিনি সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।