'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে যে অতিপ্রাকৃতের চিত্র উদঘটিত হয়েছে তা বর্ণনা করাে।

'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে অতিপ্রাকৃতের চিত্র

শােনা যায় আসর জাকিয়ে নাকি শরৎচন্দ্র বেশ গল্প বলতে পারতেন। তার ওপর যদি ভূতের গল্প হতাে, তাহলে সে গল্পের রং হতাে আলাদা, বর্ণ ভাণ্ডারের সবকটি রংই লাগাতেন তার গায়ে। কিন্তু কেবল বৈঠকী আসরে নয়। শরৎচন্দ্র যখন তার শ্রীকান্ত (১ম পর্ব) উপন্যাসে অতিপ্রাকৃত উপাদান ব্যবহার করেছেন, তখনও বলবার বিশিষ্ট রীতি অক্ষুন্ন থেকে ; বরং সে গল্প আরও গতিসম্পন্ন, আরও বিশ্বাসযােগ্য। 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে লেখক অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য নিখুঁতভাবে পরিবেশ রচনা করেছেন। সে পরিবেশের সবটুকুতে পাঠক মনে জেগে উঠেছে অপার বিস্ময়। শরৎচন্দ্র তার বর্ণনার সৌন্দর্য্যকে বিস্ময়ের মালা পরিয়ে এক অনাঘ্রাত আনন্দ প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে-


১. ওপরে মাথার ওপরে আবার সেই আলাে আঁধারের লুকোচুরি খেলা এবং পশ্চাতে বহু দূরাগত সেই অবিশ্রান্ত তর্জন। আর সুমুখে সেই বালির পাড়। এটা কোন জায়গায় তাই ভাবিতেছি, দেখি ইন্দ্র ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, শ্রীকান্ত, তােকে একটা কথা বলতে ফিরে এলুম। কেউ যদি মাছ চাইতে আসে খরবদার দিসনেখবরদার বলে দিচ্ছি। ঠিক আমার মতাে হয়েও যদি কেউ আসে, তবুও দিবিনে বলবি, মুখে তাের ছাই দেবােইচ্ছা হয় তুলে দিয়ে যা। খরবদার হাতে করে দিতে যাসনে যেনঠিক আমি হলেও না-খবরদার।

কেন ভাই ?

ফিরে এসে বলব... এইবার আমার পায়ের নখ হইতে মাথার চুল পর্যন্ত কাঁটা দিয়া খাড়া হইয়া উঠিল।


২. সেদিন শ্রাবণের অমাবস্যা। রাত্রি বারােটার পর ঝড় এবং জলের প্রকোপে পৃথিবী যেন উপড়াইয়া যাইবার উপক্রম করিল। সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ, আমি খাটের অদূরে বহু প্রাচীন অর্ধভগ্ন একটা ইজি চেয়ারে শুইয়া আছি। নিরুদিদি স্বাভাবিক মুক্ত কণ্ঠে আমাকে কাছে ডাকিয়া হাত তুলিয়া আমার কানটা তার মুখের কাছে আনিয়া ফিস্ ফিস্ করিয়া বলিলেন 'শ্রীকান্ত তুই বাড়ি যা'।

সেকি নিরুদিদি, এই ঝড় জলের মধ্যে ?

তাহােক প্রাণটা আগে। ..তিনি আমার হাতটা টানিয়া লইয়া জানালার প্রতি লক্ষ্য করিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন ; যাবিনে, তবে কি প্রাণটা দিবি? দেখচিসনে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য কালাে কালাে সেপাই এসেচে? তুই আছিস বলে ওই জানালা দিয়ে আমাকে শাসাচ্ছে।


৩. হঠাৎ একটা দমকা বাতাস কতকগুলাে ধুলােবালি উড়াইয়া গায়ের ওপর দিয়া বহিয়া গেল এবং সেটা শেষ না হইতেই আর একটা এবং আর একটা বহিয়া গেল। মনে হইল এ আবার কি? এতক্ষণ তাে বাতাসের বেগ লেশমাত্র ছিল না। যতই কেন না বুঝি এবং বুঝাই, মরণের পরেও যে কিছু একটা অজানা গােছের থাকেএ সংস্কার হাড় মাসে জড়ানো।..ক্রমশ ধীরে ধীরে বেশ একটু জোরে হাওয়া উঠিল। অনেকেই হয়তাে জানেন না যে, মড়ার মাথার ভিতর দিয়া বাতাসে ঠিক দীর্ঘশ্বাস ফেলার গােছের শব্দ হয়। দেখিতে দেখিতে আশেপাশে দীর্ঘশ্বাসের যেন ছড়াছড়ি পড়িয়া গেল।


৪. হঠাৎ কাহার পায়ের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেল। ফিরিয়া দেখিলাম শুধু অন্ধকার কেহ কোথাও নাই। একটা গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম।.. না, আর বসে থাকা নয়। কাল ডান কানের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে গেছে, আজ এসে যদি বাঁ কানের ওপর সুরু করে দেয় ত সে বড়াে সােজা হবে না।


এমনি আরও বহু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, যেগুলি মূলত অতিপ্রাকৃতের রস পরিবেশনের নিমিত্তে রচিত। তবে অতি প্রাকৃতি রস সঞ্চার করার জন্য শরৎচন্দ্র যেমন পরিবেশ সচেতন, তেমনি ভাষা সম্পর্কেও তিনি অচেতন নয়। অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনার জন্য এসেছে- 'কালো কালাে সেপাই', 'দমকা বাতাস', 'কাহার পায়ের শব্দ', 'গভীর দীর্ঘশ্বাস' এমনি আরও কত কী। শরৎচন্দ্রের এই বর্ণনাগুলি পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে আমাদের মনে হয়, হয়তাে ওই ঘটনা বা বর্ণনাগুলি সত্য নয়, কিন্তু সত্য হলেই যেন ভালাে হতাে—এমনই এক মিশ্র ভাবনা মাথার মধ্যে জট পাকাতে থাকে।


প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মনিহারা গল্পটি পাঠ করলে অপরূপ বিস্ময় সূচক ভয় জেগে উঠবে আমাদের মনে। সংশয়কে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই গল্পের প্রতিশ্রুতিকেই যেন সত্যি বলে মনে হয়। শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্রের অনুরূপ সংশয় তরঙ্গের মাঝখানে পাঠক মনের নৌকাটি সংস্থাপন করেছেন। ফলে অবিশ্বাস্য ঘটনাও বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে। শ্রীকান্তের অতিপ্রাকৃত অংশগুলি যেন- "সংশয়ের বৃন্তে ফোটা অপরূপ বিশ্বাসের ফুল।" আপন সৌরভে সে শ্রীকান্তের ভবঘুরে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সুষমামণ্ডিত করেছে। তবে সব মিলিয়ে বলতে হয়, 'শ্রীকান্ত' এর শরৎচন্র ভুতের গল্প বলতে বসেননি, কেবল একধরনের অতি প্রাকৃত আবহাওয়া যােজনা করেছেন মাত্র, সমগ্র উপন্যাসের সৌন্দর্যটাকে ওই অতিপ্রাকৃত রস একটি নতুন প্রাণ প্রবাহ দান করেছে মাত্র।