ছােট গল্প কাকে বলে? আয়তনে ছােট হলেই কি কোনাে গল্পকে ছােটগল্প বলা হবে? তােমার পাঠ্য একটি ছােটগল্প বিশ্লেষণ করে ছােটগল্পের বৈশিষ্ট্যগুলাে বুঝিয়ে দাও।

সাহিত্য ক্ষেত্রে ছােট গল্পের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এখনাে পর্যন্ত নি্ণীত হয়নি। সমালােচক মহলে এই নিয়ে জল্পনা কল্পনার কোনও অন্ত নেই। যিনি যেমনভাবে বুঝেছেন তেমন ভাবেই মতামত পোেষণ করেছেন। ফলে ছােটগল্পের সংজ্ঞা বিভিন্ন সমালােচকের অভিমত থেকে ছােট গল্প সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ধারণা লাভ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। এখন আমরা ছােটগল্প সম্পর্কের বিশিষ্ট সমালােচকদের নির্দেশিত সংজ্ঞা আলােচনা করছি।


সমালােচক এডগার অ্যালান পাে বলেছেন— “Short story writer should always bear in mind, while writing a short story, that they must not usa a single word in their writing, which is irrelevent from, their main topic they must aim at writing what is within their own perviw and not other wise." অধ্যাপক ড. অশােক কুমার মিশ্র বলেছেন- "আয়তনের দিক থেকে সংক্ষিপ্ত, ভাবের দিক থেকে অখণ্ড, অনুভূতির দিক থেকে বৈচিত্র সম্পাদনকারী গদ্যে রচিত কাহিনিই হল ছােটগল্প।"


ড. উজ্জ্বল কুমার মজুমদার তাঁর 'সাহিত্য ও সমালােচনা রূপরীতি' গ্রন্থে বলেছেন "ছোট গল্প হল এমন এক কাহিনি, যা কোন ঘটনা, পরিবেশ বা মানসিকতাকে নির্ভর করে একটি ভাবগত ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই প্রতিষ্ঠিত ভাবগত ঐক্যের গভীর প্রতীতি ক্রমশ নাটকীয় শীর্ষদেশ স্পর্শ করে, পাঠকের মনােভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে।" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছােটগল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে তাঁর 'সােনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষযাপন' কবিতাতে যা বলেছেন সেটি মনে হয় সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ অভিমত

“ছােট প্রাণ ছােট ব্যথা    ছােট ছােট দুঃখ কথা 

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতি রাশি    প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দু'চারটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনার ছটা    ঘটনার ঘনঘটা

নাহিতত্ত্ব নাহি উপদেশ

অন্তরে অতৃপ্ত রবে    সাঙ্গ করি মনে হবে

শেষ হয়ে হইল না শেষ।"


সর্বোপরি, ছােট গল্পের একখানি সর্বজন গ্রহণীয় সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলা যায়— একটি মাত্র দৃশ্য পটে স্থাপিত কোনও ঘটনায় সংক্ষিপ্ত ও তীব্র বিন্যাস, ঘটনা সূত্রের আকস্মিকতায় চরিত্রের চকিত উন্মোচন, কোনও একটি গৃঢ় অনুভবের উপর সন্ধানী আলােকপাত, ক্রান্তিলগ্নে নাটকীয়তার চমক, যে গদ্য কাহিনিতে লক্ষিত হয়, তাকে ছােটগল্প বলে।


আয়তনে ছােট হলেই কোনাে গল্পকে ছােট গল্প বলা হবে না। কারণ ছােট গল্প হতে গেলে শুধু আয়তনের দিকে তাকালে হবে না, তার সঙ্গে ছােট গল্পের বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকাতে হবে। মূলতঃ ছােটগল্প হবে দুএকটি চরিত্রের, নাটকের মতাে কাহিনি বিন্যাস, কমকথন, ভাষার সংযত ও সচেতন ব্যবহার। তাই শুধু আয়তন দিয়ে কোনও গল্পকে ছােটগল্প বলা যায় না এসবগুলি থাকতে হবে অবশ্যই।


আমার পাঠ্য একটি ছােটগল্প হল প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের 'আদরিণী'। এই গল্পটি উৎকৃষ্ট ছােট গল্প কারণ এই গল্পে চরিত্রের ঘনঘটা কম, কেবলমাত্র মূখ্য ভূমিকায় জয়রামবাবু অবতীর্ণ। এছাড়া আর দুএকটি সংক্ষিপ্ত চরিত্রের নাম পাওয়া যায়। গল্পটি আধ-ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করে দেওয়া যায়। এছাড়া গল্পটির মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা উত্তেজনা বর্তমান। গল্পটি নাটকের মতাে, সর্বোপরি এইগল্পে একটিমাত্র কাহিনি যা ছােটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই এটি একটি উৎকৃষ্ট ছােটগল্প।


ছােটোগল্পের বৈশিষ্ট্য :

(i) ছােটগল্পের আয়তন হয় সংক্ষিপ্ত।

(ii) এক নাটকীয় মুহূর্তেই কাহিনির ঘটে চকিত পরিসমাপ্তি।

(iii) আদর্শ ছােট গল্পে একটিমাত্র মহামুহূর্ত বা climax থাকে।

(iv) উপন্যাস যেমন অধ্যায় থেকে অধ্যায়ে ঘটনাক্রম অনুসারে অভিমুখে এগিয়ে চলে ছােটগল্পে তা অনাবশ্যক ও অনভিপ্রেত।

(v) নাটকের সঙ্গে ছােটগল্পের একটা সাদৃশ্য আছে।

(vi) ভাষা কাহিনি কথনের গুণে কখনাে কখনাে ছােট গল্প গীতি কবিতার মাধুর্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

(vii) ছােটগল্প অতি কথনের অবকাশ নেই। ভাষার সংযত ও সচেতন ব্যবহার সংকেতময়তা ইত্যাদি ছােটগল্প লেখবার প্রথম পাঠ।

(viii) আয়তনের স্বল্পতা ও গঠন শৃঙ্খলার অপরিহার্যতার কারণে ছােটোগল্পে বিশদ চরিত্র চিত্রণের অবকাশ থাকে না।

(ix) ছােটোগল্প তার স্বল্প পরিসরে আদি মধ্য অন্ত বৈশিষ্ট্য এক সংযত ও ঘন সংবদ্ধ শিল্প রূপ যা পাঠক মনে সৃষ্টি করে একটি একক ধারণা বা Single Impression জাগায়।

(x) ছােটোগল্পে একটি বা দুটি চরিত্রের কোনাে একটি বিশিষ্টতা। অন্তর্লোকের কোনাে এক নিগূঢ়তা হঠাৎ আলাের ঝলকানিতে উদ্ভাষিত হয়ে ওঠে।