শৈবালিনী চরিত্রের আত্মকেন্দ্রিকতা, হৃদয়বৃত্তির উগ্রতা, স্বার্থপরতার দহনজ্বালা তাকে শোচনীয় পদস্খলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং যার ফলে শুধু তার ও চন্দ্রশেখরের দাম্পত্য জীবনেই বিপর্যয় ঘটেনি, প্রতাপের জীবনও ধ্বংস গাড়িচা হয়েছে। -উপন্যাসটি অবলম্বনে এই মতের সমর্থনে তোমার মতামত দাও।

বাল্যপ্রেমকে সার্থক করতে একসাথে ডুবে মরতে গিয়ে প্রতাপ ডুবলেন, শৈবালিনী ডুবলেন না। তিনি ভাবলেন- “কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না। শৈবালিনী ডুবিল না, ফিরিল। সস্তরণ করিয়া কূলে ফিরিয়া আসিল।” যে শৈবালিনী প্রতাপের সঙ্গে প্রণয়পর্বে ভেবেছিলেন— “প্রতাপ ভিন্ন পৃথিবীতে সুখ নাই।” সেই শৈবালিনী একসাথে ডুবে মরতে গিয়ে নিজের জীবন যৌবনের প্রতি মোহবশত ফিরে এসেছিলেন। স্পষ্টতই তাঁর মধ্যেকার আত্মকেন্দ্রিকতা হৃদয়বৃত্তির উগ্রতা ও স্বার্থপরতা চমৎকার রূপে ফুটে উঠেছে।


চন্দ্রশেখর শৈবালিনীর রূপে মোহমুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করলেও নিজের অনাসক্ত, নিস্পৃহতা ও সংযমীভাবের জন্য শৈবালিনীর মনোজগতে তিনি অনুপ্রবেশ করতে পারেননি। স্বাভাবিক নিয়মেই যুবতী কামনাময়ী সুন্দরী শৈবালিনীর চিত্তলোকে প্রতাপের স্মৃতিখানি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ আট বছরের দাম্পত্য জীবনের পরও তিনি প্রতাপকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ফষ্টরের সঙ্গে কুলত্যাগিনী হলেন। চন্দ্রশেখর গৃহমধ্যে শৈবালিনীকে না পেয়ে ব্রহ্মচারী ব্রত নিয়ে গৃহত্যাগী হলেন। স্বাভাবিক নিয়মেই চন্দ্রশেখর-শৈবালিনীর দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়।


প্রতাপ শৈবালিনীর বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর চন্দ্রশেখরের জ্ঞাতীকন্যা রূপসীকে বিবাহ করে এবং চন্দ্রশেখরের দাক্ষিণ্যে ছোটো জমিদারী নিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে কালযাপন করছিলেন। অকস্মাৎ শৈবালিনীর গৃহত্যাগের সংবাদে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। ধাবিত হলেন শৈবালিনী উদ্ধারে। শৈবালিনীকে উদ্ধারের পর প্রতাপ শৈবালিনীর নিকট জানলেন, শৈবালিনী কুলত্যাগিনী হয়েছেন তাঁরই জন্যে। প্রতাপ কিন্তু নির্বিকার, তার হৃদয়ে শৈবালিনীর জন্য গোপন ভালোবাসা সঞ্চিত থাকলেও ধর্মবোধ-সমাজকে তিনি লঙ্ঘন করতে পারলেন না। শৈবালিনী বুঝলেন ইহজীবনে প্রতাপকে তাঁর আর পাওয়া হবে না। তাই তিনি প্রতাপকে বললেন– "আজি হইতে তোমাকে ভুলিব। আজি হইতে আমার সর্বসুখে জলাঞ্জলি! আজি হইতে আমি মনকে দমন করিব। আজি হইতে শৈবালিনী মরিল।"


শৈবালিনী প্রতাপের অজান্তেই তাঁর নৌকা হতে পলায়ন করে স্বেচ্ছায় অরণ্যমধ্যে নির্বাসিতা হলেন। কঠোর নরকযন্ত্রণা ভোগের পর রমানন্দ স্বামীর নির্দেশে তিনি কঠোর তপশ্চর্যায় নিরত হলেন। অবশেষে দীর্ঘ দু'বছর পর স্বামী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে বেদগ্রামে ফিরে এলেন এবং দাম্পত্য জীবনে অবতীর্ণ হলেন বটে, কিন্তু মর্মে মর্মে অনুভব করলেন প্রতাপকে তিনি আজও ভুলতে পারেননি। একান্তে প্রতাপকে তিনি জানালেন– “আমি সুখি হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই।” কারণ, “স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার; কতদিন বশে থাকিবে জানিনা। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” প্রতাপ শৈবালিনীকে সুখী করতে তিনি স্বেচ্ছায় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে প্রমাণ করলেন তাঁর ভালোবাসার নাম জীবনবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।


এর থেকেই সহজেই অনুধাবন করা চলে, আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য শৈবালিনী যেমন নিজের দাম্পত্য জীবনকে বিপর্যয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেইসঙ্গে প্রতাপকেও ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের পথে। এ সবের জন্য দাসী শৈবালিনীর আত্মকেন্দ্রিকতা, হৃদয়বৃত্তির ট্র্যাজিডির নায়িকা রূপে প্রতিস্থাপন করেছেন সেইসাথে চন্দ্রশেখরও প্রতাপকে দুঃসহ দহন জ্বালার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন।