'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'য় স্বৈরিণী নারীরূপে কালােশশী কালাে বৌ চরিত্রটির স্বরূপ বর্ণনা করাে।

'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'য় কালােশশী কালাে বৌ চরিত্র

স্বৈরিণী নারী কালােশশী— আটপৌরে পাড়ার ডাকাত পরম কাহারের বিয়ে করা বউ। আটপৌরদের গােরাচাদের বেটার বেটী। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার এক নজর কড়া চরিত্র। এই উপন্যাসের দুটি নেমেসিস একটি কন্দ্রাবাবার বাহন বিষধর চন্দ্রবােড়াকে পুড়িয়ে মারা আর একটি মুহূর্তের উন্মাদনায় কাহার পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী কালােশশীর সঙ্গে কর্তাবাবার ঠাই এর কাছে যৌনমিলন। যে পাপকর্মে কাহার পাড়ার বিপর্যয় ও বিনাশ, বনওয়ারীর অবচেতন মনের কাঁটা তাই। এবং সেই পাপেই কালােশশীর দেবরােষের বাহন শ্বেত গােখরাে সাপের দংশনে মৃত্যু। কালােশশীকে নেমেসিস বলছি এ কারণে, মাতব্বর বনওয়ারী সকল সতর্কতা ও সচেতনতা রক্ষা করে ও বারবার কালােশশীর অমােঘ আকর্ষণে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তার মাতব্বরী জীবনের পবিত্রতাকে কালােশশীর উন্মত্ত আবেগ মুহুর্মুহু দোলায়িত করেছে। বাঁশবাদি গ্রামের প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং গ্রামবাসীদের ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে কর্তাবাবার বিরূপতা বিমুখতার কালােশশী ও তার অবৈধ সম্পর্ক মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় বনওয়ারীর কাছে কখনও বা। তার মাতব্বরী জীবনের একটা evil omen জেনেও ও সে এর হাত থেকে মুক্তি পায় না। কালােশশী পরমকাহারের বিয়ে করা বউ। পরমের ডাকাতির দায়ে জেল জীবনে সে এক চরিত্রহীনা নারী। "সে চন্ননপুরের বড়ােবাবুদের দারােয়ান ভূপসিং মহাশয়ের সঙ্গে লােক জানাজানি করেই ভালােবাসা করেছিল। তার অনুগৃহীতা। তা সত্ত্বেও বনওয়ারী কাহার তার অঙের মানুষ।" বনওয়ারীর সঙ্গে তার মনে রং ছুই ছুই অবস্থা।


হাঁসুলী বাঁকের উপকথার সবচেয়ে সজীব অংশ চেতনে অবচেতনে বনােওয়ারী কালাৈশশীর প্রেমের দৃশ্য বর্ণনা। অন্তজ্য শ্রেণির মধ্যে সুপ্ত অবদমিত, দেহজ কামনা বাসনার এমন মদির আর্তির প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে কদাচিৎ আঁকা হয়েছে অন্তত দুটো দৃশ্য তাে অসাধারণ, প্রথম চেতনে-


"বনওয়ারী টলতে টলতে কালাে বউকে নিয়ে কোপাইয়ের গর্ভে এসে নামল। আকাশে সব চাঁদ উঠেছে। একপাশ খাওয়া লাল বরণ খণ্ড চাঁদ।.. বনওয়ারী কোপাইয়ের জলে গলা ডুবিয়ে বসল।...কালাে বসেছে নদীর বালিতে পা ছড়িয়ে। কালাে বউকে বড়াে সুন্দর লাগছে। তার ওপর মনে ধরছে রং, সে রং-এর ছটাও গিয়ে পড়েছে কালােশশীর মুখে, বনওয়ারী বললে মিহিসুরে এক পদ গায়েন কর কেন? অপূর্ণ প্রেমের মদিরা দুই পৌঢ়া-পৌঢ়র জীবন পত্রের কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠল সেদিন কালােবউ-এর জীবনান্তের অশুভ মুহূর্তে। বনওয়ারী বাবার বাহন শ্বেত গােখরাের দংশনে কালােশশীর দেহ 'কত্তার দেহ আছড়ে পড়ল। রােখে গেল অচরিতার্থ, অপূর্ণ প্রেমের মাধুরী বনওয়ারীর জীবনে।"


তাই অবচেতনে কালাে বউ-এর প্রেতযােনিও তাকে তাড়া করে ফেরে। "কালোে বউ-এর কথা সে ভাবছে, আটপৌরে পাড়ার বটগাছটির তলায় সে দাঁড়িয়ে আছে। ডাল দেল দিচ্ছে, হয়তাে দোল খাচ্ছে। গভীর রাতে জ্যোৎস্নার মধ্যে সে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে বনওয়ারীর ঘরের দিকে। বাঁশবাদির বাঁশবন এবং গাছপালার ছায়ায় অন্ধকারের মধ্যে জ্যোৎস্নার সাদা গুলছাপ গায়ে মেখে ঝরাপাতার ওপর পা ফেলে শব্দ তুলে এসে দাঁড়াবে, তার ঘরের পিছনে। টুপটাপ করে ঢেলা ফেলে দেবে ইশারা। আর ও গভীর রাত্রে বনওয়ারী উঠছে না দেখে গুনগুন করে গান গাইবে। তারপর ভােরের আকাশে শুকতারা উঠল সে ফিরে যাবে বাঁশবনের ভিতর দিয়ে কোপাই-এর ধারে ধারে কর্তার দহে গিয়ে নামবে ; সেখান থেকে ছুঁড়ে মারবে কৌতুক ভরে। কোপাই-এর ধারে গেলে নদীর জল অথবা বালী ছিটিয়ে দেবে গায়ে। কোনােদিন হয়তাে দেখা দেবে মনােহরিণী সাজে সেজে কোপাই-এর ধারের শিরীষ কান তুলে খোপায় পরে, অথবা দহের জলে ভেজা চিকন চুলগুলি এলিয়ে, তাতে অজস্র জোনাকি পােকা পরে কালাে মুখে সাদা দাঁতগুলি ঝিলমিকিয়ে হাসবে। কোনােদিন হয়তাে বা দেখা দেবে ভয়ঙ্করী রূপে মাথা ঠেকবে শিমূল গাছের মাথায়, চোখ দুটো জ্বলবে আগুনের আউরের মতাে, লম্বা হাতখানি বাড়িয়ে দেবে হিমের মতাে ঠাণ্ডা হাত, বনওয়ারীর ঘরের দিকে, রুদ্ধ রােষে বাঁশবাদীর অন্ধকার চোরা চিৎকার করবে অথবা অতৃপ্ত বাসনায় কাঁদবে, অন্ধকার উঠবে গুমরে"।


বস্তুত উপন্যাসে মাতব্বরী জীবনের বাইরে বনওয়ারীর যে একটা আন্তর জীবন আছে, সে আন্তর জীবনে কামনা বাসনা, প্রবৃত্তির আমােঘ আকর্ষণ থাকে, যেখানে থাকে স্বপ্ন, রােমাঞ্, জীবনকে উথাল পাতাল করে দেখা সেখানেই বনওয়ারীর জীবনে কালােশশীর অবস্থান গ্রাম্য রােমান্স সব-সময়েই মােটা দাগের হয়। কিন্তু কালাে বৌ-এর 'ভাগ্য বিড়ম্বিত রােমান্স তার হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভাসানাে, যা হাঁসুলী বাঁকের উপকথার পাঠকের বাড়তি পাওনা। তার মৃত্যু বিধির বিধান হলেও হয়তাে ট্র্যাজিক নয়। কালাে বৌ-এর মদির লালসাময় মােহবিহুলতা’র এমন প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা ঔপন্যাসিকের কঠোর অনুশাসন ব্রতের ফল হয়তাে বা পাপের বেতন মৃত্যু—ঔপন্যাসিক এই ভাবাদর্শেই কালােবৌ—এর জীবনের উপসংহার টানলেন। উপন্যাসে কালােবৌ হয়ে উঠল এক exterme character যার চরিত্রের মর্মমূলে ছিল এক elemental passion.