'শুনিয়া প্রতাপের মাথায় বজ্র ভাঙ্গিয়া পড়িল। তিনি বৃশ্চিক দষ্টের ন্যায় পীড়িত হইয়া সে স্থান বেগে পলায়ন করিলেন।' কার কথা শুনে কেন প্রতাপের এই অবস্থা বিস্তারিত লেখো। ‘বজ্র ভাঙ্গিয়া পড়িল’ ও ‘বৃশ্চিক দষ্টের ন্যায়' অংশ দুটির কী? যে সত্য প্রতাপ উপলব্ধি করলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে কী করেছিলেন?

শৈবালিনীর কথা শুনে প্রতাপের এমন অবস্থা হয়েছিল।

শৈবালিনী ও প্রতাপ বাল্য হতে ভালোবাসতেন দুজন দুজনকে। কিন্তু সামাজিক সম্পর্ক তথা আত্মীয়তার কারণে দুজনের বিবাহ সম্ভব হয়নি। ভালোবাসাকে অমর করতে তাঁরা ডুবে মরতে যান নদীতে। প্রতাপ ডুবেছিলেন কিন্তু শৈবালিনী ডুবতে পারেননি ফিরে এসেছিল। এরপর চন্দ্রশেখরের মহানুভবতায় প্রতাপ প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন এবং শৈবালিনীর রূপে প্রমুগ্ধ হয়ে চন্দ্রশেখর তাঁকে বিবাহ করতে সমর্থ হন। এই ঘটনার পর দীর্ঘ আট বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। চন্দ্রশেখরের সাহায্যে প্রতাপ রূপসীকে বিবাহ করে ছোটো জমিদারে ভূ ষিত হয়ে নিরুদ্বিগ্ন জীবন যাপনে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু নিরাসক্ত সংযমী পুরুষ চন্দ্রশেখরকে স্বামীরূপে পেয়ে যুবতী শৈবালিনীর কোনো বাসনাই পূর্ণ হয়নি। তিনি দীর্ঘ আটবছর বিবাহিতা জীবন অতিক্রান্ত করার পরও বাল্যের প্রেমিক প্রতাপকে ভুলতে পারেন না। শেষে প্রতাপের মূর্তিখানি মর্মে গেঁথে নিয়ে তিনি প্রতাপের জন্যই লরেন্স ফষ্টরের সঙ্গে কুলত্যাগিনী হন।


প্রতাপ সাহসে ভর করে ফষ্টরের নৌকা থেকে অতিকৌশলে শৈবালিনীকে মুক্ত করতে সমর্থ হন। শৈবালিনীকে উদ্ধার করার পর প্রতাপ তাঁকে পাপিষ্ঠারূপে প্রতিপন্ন করেন। এবং তিনি তাঁকে যুদ্ধে নিহত সৈনিকের মতো গুলি করে মেরে দিতে পারতেন, কিন্তু মারেননি স্ত্রীহত্যার ভয়ে। তবে শৈবালিনীর যে এখনই স্বেচ্ছায় মরণ ভালো একথা তিনি বলতে ভোলেননি। প্রতাপের কথার প্রত্যুত্তরে শৈবালিনী প্রতিবাদ না করে পারেননি। কারণ, তিনি যে আজ এমনভাবে কুলত্যাগিনী হয়েছেন সেতো প্রতাপের জন্যই। প্রতাপ যখন জানালেন তিনি শৈবালিনীর জন্যই তো বেদগ্রাম ত্যাগ করেছেন তথাপি এমন চিত্তবিকার–তা যে প্রবৃত্তির দোষ। অতএব শৈবালিনী যথার্থই পাপিষ্ঠা। শৈবালিনী এবার গর্জে উঠলেন। তিনি তাঁর পদস্খলনের জন্য প্রতাপকে দায়ী করে বলতে থাকলেন– “কেন তুমি, তোমার ওই অতুল্য দেবমূর্ত্তি লইয়া আবার আমায় দেখা দিয়াছিলে? আবার স্ফুটনোম্মুখ যৌবনকালে, ও রূপের জ্যোতি কেন আমার সম্মুখে জ্বালিয়া দিলে? যাহা একবার ভুলিয়াছিলাম, আবার কেন উদ্দীপ্ত করিয়া দিলে? আমি কেন তোমাকে দেখিয়াছিলাম? দেখিয়াছিলাম তোমাকে পাইলাম না কেন? না পাইলাম ত মরিলাম না কেন? তুমি কী জান না, তোমারই রূপ ধ্যান করিয়া গৃহ আমার অরণ্য হইয়াছিল? তুমি কী জান না যে, তোমার সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হইলে, যদি কখনো তোমাকে পাইতে পারি, এই আশায় গৃহত্যাগিনী হইয়াছি? নহিলে ফষ্টর আমার কেহ?” –শৈবালিনীর এই কথা শুনে প্রতাপের উপরিউক্ত ভাবাস্তর ঘটেছিল।


শৈবালিনীর সঙ্গে প্রতাপের বাল্য হতে প্রেম যতই থাক, সেতো অভিশাপ মাত্র। শৈবালিনী এখন চন্দ্রশেখরের গৃহিণী, এবং প্রতাপ রূপসীর স্বামী। তাঁদের প্রেমবিচ্ছেদের পর দীর্ঘ আটবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, অথচ প্রতাপ রূপসীকে নিয়ে সুখী হলেও প্রতাপ, চন্দ্রশেখরকে নিয়ে সুখী হতে পারেননি শৈবালিনী। পরস্ত্রী হয়েও তাঁর অনুধ্যানে প্রতাপেরই নাম অনুরণিত হতে থাকে। এবং প্রতাপের জন্যই তিনি ফষ্টরের সঙ্গে কুলত্যাগিনী হয়েছেন। এসকল বিবরণ শৈবালিনীর স্বকণ্ঠে শ্রবণ করার পর কার্যতঃ প্রতাপের মাথায় বজ্র ভেঙে পড়লো। অর্থাৎ মা অভাবনী, অকল্পনীয় তাই যেন শৈবালিনী উচ্চারণ করেছেন। এবং বজ্রের মতো তা যেন আকস্মিকভাবে প্রকাশ পেয়ে প্রতাপের মর্মে মর্মে আঘাত হানলো। মাথায় বাজ পড়লে যেমন বাঁচার কোনো পথ থাকে না, তেমনি প্রতাপের যেন নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের আর কোনো পথ রইল না।


বৃশ্চিকের বিষ এমন, দংশন করলে মানুষ মরে না। কিন্তু বিষের দীর্ঘ দহনে মানুষকে জীবস্মৃত করে তোলে। ধীরে ধীরে বিষের জ্বালা আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। কোনো ঔষধ প্রয়োগে তা নিবারণ করা যায় না। যতক্ষণ বিষক্রিয়া প্রবল থাকে ততক্ষণ দহন সহ্য করা যেতে হয়। শৈবালিনীর কণ্ঠে অসম্ভব কথাগুলি শোনার পর বৃশ্চিক রোগীর মতো হয়েছিল। বিবাহিত জীবনে পর নারীর মুখে বাল্যের প্রণয়ের কথা এভাবে শোনা যে পাপ অন্যায় তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে প্রতাপ শৈবালিনীর সান্নিধ্য ত্যাগ করে দ্রুত পলায়ন করেছিলেন।


প্রতাপ জানলেন তাঁরই জন্য শৈবালিনী কুলত্যাগিনী হয়েছেন। এ যে কত বড়ো অধর্মের বিষয় বোধ করি প্রতাপ ভিন্ন অন্য কারুর অবগত হওয়ার কথা নয়। আবার মুর্শিদাবাদ দরবার থেকে ইংরাজ সৈন্যদের প্রবল গোলাবর্ষনের মধ্যে থেকে শৈবালিনীকে উদ্ধার করার পর একান্তে প্রতাপ যখন শৈবালিনীর মুখে শুনলেন– “আমি সুখি হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই—” কারণ হিসাবে শৈবালিনী জানাতে ভোলেননি- “স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার ; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” প্রতাপ অনুভব করলেন, শৈবালিনী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে পুনঃ বেদগ্রামে দাম্পত্য জীবন শুরু করেছেন। এই অবস্থায় তাঁদের দাম্পত্য সুখের পথে বাধাস্বরূপ তিনি নিজে। এবং শৈবালিনী তা মুক্তকণ্ঠে ঘোষণাও করেছেন? অতএব তার ইহজগতে না বাঞ্ছনীয়। আগামী দিনে শৈবালিনীর জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিলেন। প্রমাণ করে গেলেন– তাঁর ভালোবাসার অপর নাম– জীবনবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ প্রতাপ যথার্থ সত্যি উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন শৈবালিনীকে সুখী করতে।