'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'য় নারীচরিত্র রূপে বসন্ত ও গােপীবালার স্বরূপ উদঘাটন করাে।

'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'য় বসন্ত ও গােপীবালার চরিত্র

হাঁসুলী বাঁকের উপকথার নারীরা অধিকাংশই 'প্রবৃত্তি-প্রধান দুরস্ত হৃদয়াবেগের' আধার, ব্যতিক্রম শুধু বসন্ত আর গােপীবালা। দুটি চরিত্র খুবই নিষ্ক্রিয় এ উপন্যাসে। তারমধ্যে বসন বা বসন্তকে অন্যভাবে এঁকেছেন তারাশংকর, ঔপন্যাসিকের নিজস্ব এক শ্রদ্ধা এই চরিত্রটির 'হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদির কাহা পাড়ায় মানুষদের প্রকৃতি আছে, চরিত্র নাই'। বসনের ক্ষেত্রে এই মত গ্রাহ্য নয় ? শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাে মন্তব্য করেছেন— 'একমাত্র বসনের প্রেম শান্ত একনিষ্ঠতার গৌরবমণ্ডিত হইয়া প্রবৃত্তিপ্রধান দুরন্ত হৃদয়রােগ বিপরীত দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করিয়াছে'। বসন্ত অবশ্যই সতী নয়, কাহার কন্যারা। সতী হয় না। কাহারদের মেয়েরা সতী হলে ভদ্রজনদের পাপ ধরবে কারা, রাখবে কোথা? চৌধুরীবাবুর মাতাল ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের কথা সবাই জানে। তথাপি "কাহার পাড়ার বিচিত্র মেয়ে বসন্ত ওই চৌধুরীর ছেলেকে সে যে ভালােবেসেছিল, তারপর সে আর কারও দিকে ফিরে তাকায় নাই। কাহার পাড়ার নীল বাঁধের শালুকের বনের মধ্যে পদ্মকলি যেমন উদায়াস্ত সূর্যের দিকেই চেয়ে থাকে, তেমনি ওই একজনের দিকেই ছিল মনপ্রাণ চোখ সব। চৌধুরীদের ছেলের মৃত্যুর পর সে থাকত স্বজাতের গৃহস্থ ঘরের বিধবার মতাে। শান্ত মৃদুভাষী বসন্ত"। প্রবৃত্তিবেগের দাহ তার মধ্যে ছিল। আর সেই কারণেই কোমার্যে তার অবৈধ সন্তান পাখি। চৌধুরীদের মেজছেলের ঔরসজাত সন্তান। তাকে বৈধ করার জন্য এক জরাজীর্ণ খোড়া কাহার ছেলেকে ঘুষ দিয়ে নিয়ে এসেছিল বসনের মা সুচাদ। পিতৃত্বের দায়িত্ব তার ওপর চাপিয়ে বসন্ত এবং পাখিকে রক্ষা করেছিল। বসন্ত তার প্রেমের ঔজ্জ্বল্যেই ক্রুণ হত্যা করতে দেয় নি। তাই পাখির আত্মহত্যার পর "বসন ও কাঁদলে। সে কাঁদলে শুধু মৃতস্বামীর জন্য নয়, জঙ্গলের চৌধুরী বাড়ির ছেলের জন্যে কাঁদলে। তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন" হৃদয়ের গভীর প্রেমই তাকে শান্ত সুশীলা করেছে, প্রবৃত্তির উর্ধ্বে উঠিয়াছে। কাহার নারীদের মধ্যে ও সে খাপছাড়া তাই এবং সেই কারণেই বাঁশবাদী গ্রামে সে এক নিঃসপত্ন নারী। সমাজ শাসনে তার শ্রদ্ধা, আধিদেবিকতায় সে। বিশ্বাসী আবার প্রবল সন্তান স্নেহ-পরায়ণ জননী। করালী ও পাখির মঙ্গলের জন্য সে হাঁস বলির মানত করে। সমাজ শাসনকে উপেক্ষা করে করালীর কোঠাঘর বানানাের পরিকল্পনায় শঙ্কিত হয়। তার অমেয় বাৎসল্যরসের ধারাটিকে পাখি কি গভীরভাবে উপলব্ধি করে- 'মা তাে তার শুধু মা নয় তার পরাণের সখী। এমন মা কারও নাই। পাখি অকপট বলে সকল তার মাকে। কখনও তার মেয়েকে তিরস্কার করে না। সে সে তার চুল বেঁধে মুখ মুছিয়ে দেয়। ঠাট্টা করে বলে ভালাে হয়েছে কিনা করালীকে শুধাস'। বসন কখনও চরিত্রে একধারে প্রেমিকা, জননী এবং সুঅভিভাবিকার ত্রয়ী সম্মেলন দেখতে পাই।


মাতব্বর বনওয়ারীর ঘরনী কি কাহার রমণী নয় ?


উপন্যাসের সুচাদের মুখ দিয়ে বারবার বলানাে হয়েছে, কাহারদের তরুণী মেয়ে বানভাসা কোপাইয়ের মতাে ক্ষেপে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে দাঁড়ায়। সেদিক থেকে পাখি, কালাে বৌ, সুবাসী, সিধু নয়নের মা বসনের পাশে গােপালীবালার হৃদয়ের প্রবৃত্তি বেগের বহিঃপ্রকার নেই বললেই চলে। শুধু একবার সুবাসীকে সাঙা করার সময়ে পাগল পিরীতির ছােট্ট একটুকু ছোঁয়ায় গােপালীবালার মনে রং ধরানের চেষ্টা একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা দেখাতে চেয়েছিলেন ঔপন্যাসিক, কিন্তু তাকে গভীরতা দিতে পারেননি। আসলে বনওয়ারী মাতব্বরের জৈবিক প্রবৃত্তি পরায়ণ জীবনে বিবাহিতা ঘরণী গােপালীবালার চরিত্র তাৎপর্যহীন হয়ে যেতে বাধ্য। আগাগােড়াই সে নিরীহ, সুশীলা। ভালােমানুষ। বনওয়ারীর মুখে ময়দা নেপা পরিবার সে। সন্তান ধারণে অক্ষম বলেই সংসারে সে অবাঞ্ছিত। বনওয়ারীর অনুভবে গােপালীবালার মধ্যে কোপাইয়ের ঢেউ নাই, মনে সে দোলা লাগাতে পারে না, সে হল নীলার বাঁধের জল, না আছে সাঁড়া, না আছে ধারা, চুপচাপ ঠাণ্ডা শীতল, বুক ডুবিয়ে বসে থাকলে নড়বে না, জড়িয়ে ঘিরে নিথর হয়ে থাকবে। বনওয়ারীর গােপালীবালার ওপর নেশা কখনও জমেনি। All women are jealous এই আপ্ত বাক্য অনুযায়ী গােপালীবালার ঈর্ষা আছে কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া নেই বলে মাত্র কুড়ি টাকার বিনিময়ে সে সুবাসীকে সতীন হিসেবে মেনে নেয়। আঁজলা ভরা ঝকঝকে টাকা দেখে সে কান্না ভুলে স্বামীর দিকে চেয়ে হাসে, আবদার করে, সােনার কানফুল গড়িয়ে দিতে। গােপালীবালা বােকা-সােকা মানুষ, কিন্তু বােধবুদ্ধিহীন নয়। কালােশশী তাকে দেখে মুখ টিপে যে হাসত তার অর্থ সে বুঝত, সুবাসীকে ঘরে আনার অর্থ যে কালােশশীকেই নতুন করে পাওয়া সে কথা বনওয়ারীকে জানিয়ে দিতে ভােলে না গােপালীবালা। তথাপি ঔপন্যাসিক গােপালীবালা। চরিত্রটি কাহাররমনী সুলভ বৈশিষ্ট্য মার্জিত করলেন না। কেন তা বােঝা দুষ্কর। চরিত্রে দ্বন্দ্ব না থাকলে চরিত্র সজীব হয় না। গােপালীবালা চরিত্রে দ্বন্দ্ব ভাই কেন এটাই পাঠকের বিস্মিত ঔৎসুক্য।


হাঁসুলী বাঁকের উপকথার চরিত্র সৃষ্টিতে তারাশংকর কোনাে জটিলতা আনতে চাননি, সে পুরুষ কী নারী উভয় ক্ষেত্রেই। বাস্তবের খাঁটি মানুষ এরা। জৈবিক প্রবৃত্তির কাছে তারা লগ্ন হয়ে থাকে। শিক্ষা সংস্কৃতি পরিশীলিত জীবনবােধ মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। কিন্তু হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে অসংকোচে তিনি চারিত্রিক রহস্য সমূহকে উন্মােচিত করে দিয়েছেন। জটিল মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তিনি গ্রহণ করেননি। বৈচিত্র্যসন্ধানী তারাশংকর বিশেষ করে নারী চরিত্রগুলির মধ্যে জৈবিক প্রবৃত্তিকে উপপাদ্য করে হৃদয়গত চিত্তবৃত্তির বঙ্গাহীন প্রবাহকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি সংস্কার আদর্শবােধ ভাবালুতা বা এজাতীয় কোনাে Preconceived idea-কে প্রশয় দেননি।