'ঐতিহাসিক পরিবেশ সত্ত্বেও ‘চন্দ্রশেখর’ ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়– মূলত সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।' –এই মত কি সমর্থন করো? উত্তরের সাপেক্ষে যুক্তি দাও।

‘চন্দ্রশেখর' উপন্যাসে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট কিয়দংশ উদঘাটিত হলেও তবে তা পুরোপুরি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। এর কাহিনি গ্রন্থনের গতিপ্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে নির্দ্বিধায় মন্তব্য করা চলে 'চন্দ্ৰশেখর ইতিহাসাশ্রয়ী সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। চন্দ্রশেখর উপন্যাসে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীরকাসেমের সমসাময়িক যে ইতিহাসটুকু স্থান পেয়েছে তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ মূল কাহিনির সঙ্গে তার বিশেষ সংযোগ অনুভূত হয় না। কারণ এ উপন্যাসের মূল কাহিনিটি যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনায় সংস্থাপিত করে রচনা করা সম্ভব। কাজেই আলোচ্য উপন্যাসে যেটুকু ইতিহাস স্থান পেয়েছে তা গৌণ মাত্র। মূলতঃ এ উপন্যাস রচনায় সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবধারা ফুটিয়ে তোলাই ছিল লেখকের মূল উদ্দেশ্য। অন্ততঃ উপন্যাস পর্যালোচনায় এমনই লক্ষণই প্রকট হয়ে ওঠে। ভাগীরথী তীরে, আম্রকাননে বসিয়া একটি বালক ভাগীরথীর সাধ্য জলকল্লোল শ্রবণ করিতেছিল। তাহার পদতলে, নবদুর্বাশয্যায় শয়ন করিয়া, একটি ক্ষুদ্র বালিকা নীরবে তাহার মুখপানে চাহিয়াছিল – চাহিয়া, চাহিয়া, চাহিয়া আকাশ নদীবৃক্ষ দেখিয়া, আবার সেই মুখপানে চাহিয়া রহিল। বালকের নাম প্রতাপ বালিকার নাম শৈবালিনী। শৈবালিনী তখন সাত আট বৎসরের বালিকা প্রতাপ কিশোর বয়স্ক। উপন্যাসের প্রথমেই এই বর্ণনাতে সুস্পষ্ট প্রতাপ ও শৈবালিনী কীভাবে ধীরে ধীরে তারা বাল্য-কৈশোর থেকে ক্রমেই যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন, এখানে নেই ইতিহাসের কোনো স্পর্শ, আছে সমাজ পরিবেশের উত্তাল তরঙ্গ। এরপর লেখক জানিয়েছেন– উভয়ের মধ্যে ভালোবাসা জন্মাল। “ষোলো বৎসরের নায়ক– আট বৎসরের নায়িকা।” তবে নায়কের মতো কেউ ভালোবাসতে জানে না এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে লেখক আরও জানিয়ে রাখলেন– “বাল্যপ্রণয়ে কোনো অভিশম্পাত আছে।” অর্থাৎ উভয়ে মধ্যে যে পরবর্তী কালে প্রণয় সংঘটিত হবে না তারও লেখক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যে উপন্যাসের শুরু এই দিয়ে তাকে মনস্তত্ত্বের আধারে গড়ে উঠবে বলাই বাহুল্য।


প্রতাপ ও শৈবালিনীর প্রেমকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয়েছে পরবর্তীকালে সামাজিক সমস্যা। শৈবালিনী জানতেন প্রতাপের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে। কিন্তু প্রতাপ জানতেন শৈবালিনীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে না। কারণ, শৈবালিনী তাঁর প্রতিবেশী কন্যা, পিতৃহারা, দরিদ্র, প্রতাপ দরিদ্র হলেও সামাজিক কনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তাঁদের বিবাহ সম্ভব নয় তা শৈবালিনী না জানলেও প্রতাপ জানেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের লালিত ভালোবাসার কি হবে? তাই তাকে সমাধিস্থ করতে উভয়েই গঙ্গাবক্ষে ডুবে মরার পরিকল্পনা করলেন। প্রতাপ ডুবলেন, কিন্তু শৈবালিনী ডুবলেন না। প্রথমত, মরতে তাঁর ভয় করে। দ্বিতীয়ত, প্রতাপ তাঁর কে যে তাঁর জন্য তাঁকে মরতে হবে। শৈবালিনী ফিরে এলেন। তবে মৃত্যুকে এড়ালেন বটে। প্রতাপের ভালোবাসা মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেন না। শুরু হল মানসিক টানাপোড়েন। তবে সৌভাগ্যের বিষয় চন্দ্রশেখরের সৌজন্যে প্রতাপের মরা আর হয়নি।


শৈবালিনীর রূপে টলে গেল ব্রতচারী ব্রহ্মচারী চন্দ্রশেখরের মন। তিনি শৈবালিনীকে বিবাহ করে ফেললেন। কিন্তু শৈবালিনীর মতো কামনাময়ী নারী কেমন করে চন্দ্রশেখরের মতো নিরাসক্ত পুরুষকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন? সম্পূর্ণরূপে চন্দ্রশেখরকে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। প্রতাপের ভালোবাসা মন থেকে মুছে ফেলতে না পারলেও সামাজিক বিধি লঙ্ঘন করে প্রতাপের কাছে ফিরে যাওয়ার দুঃসাহসিকতা তাঁর নেই। আবার ততদিনে প্রতাপও একা নেই, তিনি রূপসীকে নিয়ে সংসার পেতেছেন। কামজর্জরিতা শৈবালিনীর দিন আর কাটতেই চায় না। এমনি সময়ে তিনি ডাক পেলেন ইংরাজ কুঠিয়াল লরেন্স ফষ্টরের। যিনি ভীমা পুষ্করিণীতে শৈবালিনী রূপ দেখে প্রমুগ্ধ হয়েছিলেন। বেদগ্রামের সবাই জানলেন লরেন্স ডাকাতি করে রাতের অন্ধকারে অসহায়া শৈবালিনীকে তুলে নিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শৈবালিনী চন্দ্রশেখরকে জানিয়েছেন স্বেচ্ছায় তিনি লরেন্সের সঙ্গে সংসার ছেড়েছেন। তবে কামনাবাসনার তাড়নায় শৈবালিনী ঘর ছাড়লেও ক্ষণিকের দুর্বলতায় তিনি নিজেকে কলুষিত করেননি।


স্ত্রী শৈবালিনীকে কাছে পেয়ে তাঁর রূপে প্রমুগ্ধ হয়ে চন্দ্রশেখর আত্মহারা হয়ে পড়ে ছিলেন। স্ত্রীলোকের প্রতি তাঁর এতদিনকার উন্মাসিকতা পরিত্যাগ করে তিনি শৈবালিনীর রূপসৌন্দর্যে মগ্ন রেখে দিলেন। কিন্তু যখন জানলেন ইংরাজদের দ্বারা শৈবালিনী অপহূতা হয়েছেন, তখন তাঁর সাধের সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গেল, সংসারের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি প্রতিবেশীদের নিকট একে একে বিতরণ করে দিয়ে মনোমুগ্ধকর শাস্ত্ররাজি একত্রিত করে অগ্নি সংযোগ করলেন এবং সবার অজান্তেই নিঃশব্দ রাতের অন্ধকারে বেদগ্রাম ত্যাগ করে নিরুদ্দিষ্ট হলেন। তিনি কোথায় গেলেন কেউ জানলেন না। আজীবন ঈশ্বরাধনা করে এসে শৈবালিনীর জন্য তাঁর আজ এমন অবস্থান্তর।


শৈবালিনীকে ত্যাগ করে রূপসীকে বিবাহের পর চন্দ্রশেখরের বদান্যতায় প্রতাপের দিনগুলি বেশ ভালোয়-মন্দয় কাটছিল। তিনি ছোট্টো জমিদারে রূপান্তরিত হয়েছেন, কিন্তু যখনই তিনি সুন্দরীর মারফৎ জানলেন শৈবালিনী অপহূতা হয়েছেন, তখন আপন সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে তিনি শৈবালিনীর উদ্ধারকার্যে ছুটলেন। অসম সাহসিকতায় শৈবালিনীকে ইংরাজদের নিকট হতে উদ্ধার করলেন বটে, কিন্তু সামান্যতম অসতর্কতার কারণে তিনি ইংরাজদের নিকট বন্দি হলেন। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে শৈবালিনীর বিবাহ হলেও মন থেকে তিনি প্রতাপকে মুছে ফেলতে পারেননি। যখন তিনি জানলেন প্রতাপকে ইংরাজরা ধরে নিয়ে গেছে, প্রবল বুদ্ধিমত্তায় নবাব মীরকাসেমের সহায়তায় প্রতাপ উদ্ধারে নিজেকে নিয়োগ করলেন। এবং প্রতাপ সহ ইংরাজ নৌকা থেকে তাঁরা যথাসময়ে গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে পলায়ন করলেন। এইসময় শৈবালিনী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন, প্রতাপ ছাড়া তাঁর ইহজীবনে কোনো সুখ নেই। অথচ প্রতাপকে গ্রহণ করার মতো কোনো পথ তাঁর সামনে নেই। তিনি প্রতাপের জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে এইসময় প্রতাপকেই না জানিয়ে নদীতীরের অরণ্যমধ্যে আত্মগোপন করলেন এবং দৈববলে চন্দ্রশেখরের সাহচর্য পেয়ে কঠোর তপোশ্চর্যার পর বেদগ্রামে ফিরে এসেছিলেন।


উপন্যাসমধ্যে মীরকাসেমের উপপত্নীরূপে স্বীকৃতি লাভ করলেও দলনী বেগম কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্র। তবে তাঁর প্রেম, প্রণয়, নিষ্ঠা, পাতিব্রত্য বাঙালি বধূদের মুগ্ধ করে ছাড়ে। তিনি নবাবের মঙ্গলকামনায় উৎকণ্ঠিত হয়ে অন্তঃপুর ত্যাগ করে পথে নেবে নিজের সর্বনাশকে নিজের অজান্তেই ত্বরান্বিত করে তুলেছিলেন, তাতে বোধ করি, বিধাতা পুরুষ তাঁর প্রতি রুষ্ট ছিলেন নইলে তাঁর মতো সতীনারীর পরিণতি এমন করুণ ও মর্মান্তিক হোত না। যে নবাবের জন্য তিনি পথে নেমেছেন, সেই নবাব মিথ্যা প্ররোচনায় বিষপানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ তাঁর প্রতি আরোপ করেন। দলনী নবাবের আদেশকে শিরোধার্য রূপে মেনে নিয়ে কোনো প্রতিবাদ না জানিয়ে নিষ্পাপ চরিত্রের অধিকারী হয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করলেন। পরে নবাব যখন জানলেন দলনী নিষ্পাপ কলংকবিহীন, তখন গভীর কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েছেন।


নবাব বিচারাসনে আসীন। লরেন্স ফষ্টর ও তকি খাঁর অপরাধের বিচার করবেন। যথাসময়ে বিচার সমাপন হয়েছে। এমনি সময়ে ইংরাজরা অতর্কিতে নবাবকে আক্রমণ করেছে। বিচারসভায় উপস্থিত ছিলেন চন্দ্রশেখর, শৈবালিনী, রমানন্দ স্বামী। বাঁচার কোনো পথ নেই। এইসময়ে দেবদূতের মতো সসৈন্যে সেখানে হাজির হন প্রতাপ। অক্ষত অবস্থায় ফিরে এলো ওঁরা তিনজন। তারপর একান্তে প্রতাপকে শৈবালিনী কাছে ডেকে জানালেন– “যতদিন তুমি পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত বড়োই অসার ; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এজন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” অর্থাৎ প্রতাপকে দর্শনমাত্রই শৈবালিনীর চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, ইহজীবনে তিনি বোধ করি প্রতাপকে ভুলতে পারবেন না। প্রতাপ শৈবালিনীর জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে চন্দ্রশেখরের নিষেধ সত্ত্বেও অশ্বারোহে ছুটে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিতে। তিনি মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে রমানন্দ স্বামীকে জানিয়ে গেলেন– “আমার ভালোবাসার নাম জীবন বিসর্জ্জনের আকাঙ্ক্ষা।” অর্থাৎ শৈবালিনী ভালোবাসার মধ্যে আত্মসুখ অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলেন আর প্রতাপ ভালোবাসার মধ্যে আত্মত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।


এ যাবৎ স্পষ্টই প্রতীয়মান, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চন্দ্রশেখরের কাহিনি চয়ন হলেও এর মূল বিষয়ের সঙ্গে ইতিহাসের তেমন কোনো গভীর সংযোগ অনুভূত হয় না। ইতিহাসের দ্বারা এর মূল কাহিনি ধারা আবর্তিত হয়নি। এর পরতে পরতে অভিষিক্ত হয়েছে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। এবং তা নির্ণীত হয়েছে প্রতাপ-শৈবালিনী-চন্দ্রশেখরের জীবনকে ঘিরে। যাঁরা একেবারেই অনৈতিহাসিক চরিত্র। অতএব 'চন্দ্রশেখর' ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, - সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসমাত্র।