'এ জলের তো তল আছে আমি যে অতল জলে ভাসিতেছি।' –বক্তা কে? কী প্রসঙ্গে সে এই উক্তি করেছে? উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য উক্তিটির বক্তা হলেন শৈবালিনী। উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে 'অগাধ জলে সাঁতার' অংশে এই উক্তিটি করেছেন।


প্রবল বিক্রমে ফক্টরের নিকট হতে অপহুতা শৈবালিনীকে উদ্ধার করার পর প্রতাপ ইংরাজদের রোষে পড়েছিলেন। এবং অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইংরাজদের নিকট বন্দি হলে শৈবালিনী তাঁকে উদ্ধারের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এবং নবাব মীরকাসেমের সহায়তায় তিনি ছদ্মবেশে বন্দি প্রতাপের নৌকাতে এসে হাজির হন, কৌশলে ইংরাজের চোখে ধূলো দিয়ে তাঁরা নৌকা হতে গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে পলায়ন করেন। এই গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার দেওয়ার সময় প্রতাপ তাঁর অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন এইভাবে– “কেনই বা মনুষ্য অদৃষ্টে ওই সমুদ্র সাঁতার নাই? কেনই বা মানুষে ওই মেঘের তরঙ্গ ভাঙ্গিতে পারে না? কী পুণ্য করিলে ওই সমুদ্রে সন্তরণকারী জীব হইতে পারি? সাঁতার। কি! ক্ষুদ্র পার্থিব নদীতে সাঁতার? জন্মিয়া অবধি এই দূরন্ত কাল সমুদ্রে সাঁতার দিতেছি, তরঙ্গ ঠেলিয়া তরঙ্গের ওপর ফেলিতেছি—তৃণবৎ তরঙ্গে তরঙ্গে বেড়াইতেছি—আবার সাঁতার কী?” অর্থাৎ প্রতাপ তাঁর এই সাঁতারকে নিজের জীবনের উত্থান-পতনের সঙ্গে রূপকার্থে দেখেছেন। সত্তরণকালে প্রতাপের উক্ত ভাবনা শৈবালিনী ভাবতে থাকেন— “এ জলের তল আছে, আমি যে অতলজলে ভাসিতেছি।”


উপরিউক্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শৈবালিনী তাঁর উদ্ভুত জীবন বিপর্যয়ের কথা ব্যক্ত করেছেন। বাল্য হতে প্রতাপকে তিনি ভালোবেসে এসেছেন, সামাজিক কারণে তাঁদের বিবাহ সম্ভব হয়নি। ডুবে মরতে গিয়েও জীবনের প্রতি গভীর আসক্তিবশতঃ তাঁর মরা আর হয়ে ওঠেনি। চন্দ্রশেখরের মতো সুপুরুষের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হওয়া সত্ত্বেও নারীজীবনের সমস্ত সাধ আল্লাদ থেকে তিনি বঞ্চিত হন। জীবনের কোনো এক অদম্য আসক্তির টানে বিভ্রান্ত চিত্তে তিনি স্বেচ্ছায় লরেন্স ফষ্টরের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিলেন। কুলত্যাগিনী হওয়ার পর বুঝেছিলেন তিনি জীবনে কী মহা ভুল করেছেন। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে বিবাহিত জীবনে তিনি ক্ষণিকের জন্য প্রতাপকে ভুলতে পারেননি। প্রতাপের জন্যেই তিনি ফষ্টরের সঙ্গে বাড়ির বাইরে পা রেখেছেন। সেই প্রতাপ জীবন পণ করে তাঁকে উদ্ধার করেছেন, আবার প্রতাপের বন্দিত্ব মোচন করতে শৈবালিনী নারী হয়ে দুঃসাহসিক অভিযানের সামিল হয়েছেন। অর্থাই তাঁর সমগ্র জীবনটাই তো প্রতাপময়। প্রতাপকে হারিয়ে তিনি ক্ষণিকের জন্য কোথাও স্থির থাকতে পারেননি। তিনি সংসারের অঙ্গন হতে বহিরঙ্গনে পা রেখে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন। এখন তিনি কূল হারিয়ে অকূলে ভাসছেন। তাঁর অবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিজে অবস্থাকে প্রতীয়কায়িত করতে শৈবালিনী উপরিউক্ত মন্তব্য করেছেন।