শ্রীকান্ত উপন্যাসের নিসর্গ প্রকৃতির বর্ণনা দাও।

'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের নিসর্গ প্রকৃতি

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নিসর্গ চর্চা কোনাে নতুন বিষয় নয়, তবে তা অবশ্যই শরৎচন্দ্রের নিজস্ব রীতিতে। নক্ষত্র খচিত অন্ধকার আকাশ, কালােমেঘ, ঝড়ঝঞ্জা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, নদী বিশেষত গঙ্গা, প্রবল শ্রোতা প্রবাহ- শরৎচন্দ্রের এইসব প্রিয় বিষয়গুলি শ্রীকান্ত ছাড়াও 'দেনাপাওনা', 'চরিত্রহীন:, 'গৃহদাহ', 'পথের দাবী' বা বিভিন্ন ছােটোগল্পে পাওয়া যায়। আর এইসব গ্রন্থে নরনারীর মনের বিভিন্ন অবস্থার প্রকাশে প্রকৃতি যেমন ব্যঞ্জনাগী হয়ে উঠেছে তেমনি আবার অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় concreat representation of nature, কখনও বা প্রকৃতি এক সক্রিয় প্রাণসত্তায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে।


‘শ্রীকান্ত' (১ম খণ্ড) উপন্যাসের শুরুতেই শ্রীকান্তের জবানীতে লেখক বলেছেন- “ভগবান আমার মধ্যে কল্পনা কবিত্বের বাষ্পটুকুও দেন নাই। এই দুটো পােড়া চোখ দিয়া যা কিছু দেখি ঠিক তাহাই লিখি।... এমন করিয়া ভগবান যাহাকে বিড়ম্বিত করিয়াছেন, তাহার দ্বারা কবিত্ব সৃষ্টির করা চলে না। চলে শুধু সত্য কথা সােজা করিয়া বলা।"


এই উপন্যাসের প্রকৃত চিত্ৰণ লেখকের এই অতিবিনয়ের বিরােধিতাই করে। অনেক ক্ষেত্রেই উপন্যাসিকের অন্তরে এক কবির আবির্ভাব হয়েছে। কোনাে কোনাে স্থানে নিসর্গ বর্ণনা অসাধারণ প্রতীকী ব্যঞ্জনাও লাভ করেছে। আর সব মিলিয়ে প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্রের এক নিপুণ সৌন্দর্যবােধ। এই সৌন্দর্য দর্শনের কয়েকটা দিক লক্ষ্য করা যায়


ক) ভয়ঙ্করের মধ্যে সৌন্দর্যদর্শন।

খ) মানুষের সাথে প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনজাত সৌন্দর্য উপলব্ধি।

গ) কখনও নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে একটা বিরাট সত্তা বলে অনুভব এবং অনেকক্ষেত্রে তাকে সম্বোধন করে উক্তি। সূর্যাস্ত মানেই অন্ধকার, আর অন্ধকারকে কবি সাহিত্যিক বিষাদ-মৃত্যু নৈরাশ্য বিদায় ইত্যাদি সূচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কখনও বা অন্ধকার এসেছে একটু ভিন্নমাত্রা নিয়ে। যেমন—


  • “রাত্রির যে একটা গভীর রূপ আছে, তাহাকে পৃথিবীর গাছপালা, পাহাড় পর্বত, জল-মাটি, বন-জঙ্গল প্রভৃতি জাতীয় দৃশ্যমান বস্তু হইতে পৃথক করিয়া একান্ত করিয়া দেখা যায় ইহা যেন আজ এই প্রথম চোখে পড়িল।"

  • “অস্তগামী সূর্যের তির্যক রশ্মিচ্ছটা ধীরে ধীরে নামিয়া আসিয়া দীঘির কালাে জলে সােনা মাখাইয়া দিল।"


প্রথম উদাহরণে যে দাশনিক অনুভব তা মূলত শরৎচন্দ্রের কবি সত্তাকেই বিকশিত করে। দ্বিতীয় উদাহরণটিতে দীঘির কালােজলে সােনা মাখনাের যে চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে তা এক স্বতন্ত্র সৌন্দর্যবােধকে প্রকাশিত করেছে। আবার প্রথম দৃষ্টান্ত রাত্রিকে নিমীলিত চোখে ধ্যানরত কল্পনা এবং স্তন্ধ বিশ্বের শান্তিরক্ষা জড় প্রকৃতির এক অদ্ভুত humanised representation। এই উপলদ্ধি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ছিন্নপত্রাবলীর রবীন্দ্রনাথকে। তবে উপন্যাসের সাপেক্ষে তা শুধু সৌন্দর্য উপভােগ বা দার্শনিক অনুভব হয়েই থাকেনি, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের সম্পর্কের মধ্যে অসাধারণ ব্যানার সৃষ্টি করেছে। কেননা কুমার বাহাদুরের সঙ্গে শিকারে এসে বাল্যসহচেরী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে শ্রীকান্তের পরিচয় হয়। মাঝের কতাে ইতিহাস লুকিয়ে আছে অতীতের অন্ধকারে। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তের 'মজাদীঘিিটি সেই ছেদ পড়া মুছে যাওয়া সম্পর্কের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আবার রাজলক্ষ্মীকে বেশ কিছুটা বােঝার পর শ্মশানে এসে শ্রীকান্ত অন্ধকারের রূপ দর্শন করে। ঠিক তার পরের অনুভূতি আমাদের স্পষ্ট করে দেয় যে এই অন্ধকারের রূপ আসলে অব্ধকারময় জীবনে নিমজ্জিত রাজলক্ষ্মীর মধ্যেও যে এক সংগুপ্ত নারী, আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে অন্ধকারের এই সৌন্দর্যময় রূপ 'চরিত্রহীন'- এর কিরণময়ীর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।


দ্বাদশ পরিচ্ছেদের শেষে সূর্যাস্তের পটভূমিতে শ্রীকান্তের অনুভূতি- "চোখের ওপর সূর্য অস্ত গেল। সেইদিকে চাহিয়া চাহিয়া আমার সমস্ত অন্তঃকরণটা যেন গলিয়া রাঙা হইয়া উঠিল। মনে মনে কহিলাম, রাজলক্ষ্মীকে আর ত আমি ছােটো করিয়া দেখিতে পারি না।" যে সূর্যাস্ত শ্রীকান্তের সৌন্দর্য চেতনার একটি প্রিয় বিষয়, সেই সূর্যাস্তের সময়েই এক রঙিন রাগে রাজলক্ষ্মীর সম্পর্কে শ্রীকান্তের এই মনােভাব। অন্যদিকে তৃতীয় পরিচ্ছেদের প্রথমেই অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম বর্ণনা পাওয়া যায় তা কোনাে চরিত্রের মন তত্ত্ব বিশ্লেষণের সহায়ক না হলেও কবি সত্তাকে এবং সৌন্দর্যবােধকে প্রকাশিত করে- "স্তিমিত চক্ষে চুপ করিয়া আকাশের গায়ে মেঘ ও চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখিতে লাগিলাম। ওই ভাসে, আবার ডােবে, আবার ভাসে, আর কানে আসিতে লাগিল জলস্রোতের এই একটানা হুংকার।" এই জলস্রোতের একটা হুংকার বােধ হয় একটু প্রতীকী। আবার অন্য একটি দৃষ্টান্ত এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে- "কয়েক মুহূর্তেই ঘন অন্ধকার সম্মুখ এবং পশ্চাত লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। শুধু দক্ষিণ ও বামে সমান্তরাল প্রসারিত বিপুল উদ্দাম জলস্রোত এবং তাহারই ওপর তীব্র গতিশীল, এই তরনীটি এবং কিশাের দুটি বয়স্ক বালক।" এখানে এই প্রাকৃতিক চিত্র বর্ণনায় দ্বারা ফুটে উঠেছে দুই কিশােরের দুঃসাহসিকতা।


মূলত 'শ্রীকান্ত' এর এইসব প্রকৃতি চিত্রণে শরৎচন্দ্র একাধারে চিত্রকর এবং দার্শনিক। অন্ধকার, চাঁদ, মেঘ বা শ্মশানের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি বর্ণনায় তিনি যেমন অসাধারণ ছবি উপহার দিয়েছেন তেমনি আবার কোনাে ক্ষেত্রে গভীর দার্শনিক প্রত্যয়ও ধরা পড়েছে অন্ধকারের প্রেক্ষিতে। আর সব থেকে বড় কথা প্রকৃতির এইসব নিপুণ চিত্রণ উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের সাপেক্ষে অনেকাংশেই ব্যঞ্জনাগ্ভী হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ নিসর্গ প্রকৃতি এখানে মাত্র চিত্রগুণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রকৃতি চিত্রণে বােধকরি শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব নিহিত এখানেই।