‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে শােভনলাল চরিত্রটি নিরূপণ করাে।

‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে শােভনলাল চরিত্র

শােভনলালের পরিচয় এ উপন্যাসে প্রয়ােজনের তুলনায় অতি সংক্ষিপ্ত। 'লাবণ্য-পুরাবৃত্ত' প্রসঙ্গে প্রথম শােভনলালের উল্লেখ পাওয়া যায়। লাবণ্যের পিতা পশ্চিমী কলেজের অধ্যাপক অবনীশ দত্তর এক স্নেহের পাত্র হিসাবে তাকে পরােক্ষে উপস্থিত করা হয়েছে এ উপন্যাসে। তার দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমনই- "তার নাম শােভনলাল। অল্প বয়সে পড়ার প্রতি এত মনােযােগ আর কারও দেখা যায় না। প্রশস্ত কপালে, চোখের ভাবে স্বচ্ছতায়, ঠোটের ভাবের সৌজন্যে, হাসির ভাবের সরলতায়, মুখের ভাবের সৌকুমার্যে তার চেহারাটি দেখবামাত্র মনকে টানে। মানুষটি নেহাৎ মুখচোরা, তার প্রতি একটু মনােযােগ দিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।" এই শােভনলালকে পড়াতেন অবনীশ, ভবিষ্যতে শােভন যে নাম করতে পারবে তেমনই ধারণা ছিল অবনীশের। শােভন আসত তার বাড়ীতে পড়তে।


শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কন্যা লাবণ্য, পড়াশুনায় আগ্রহী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না, সুতরাং প্রথম বয়সে তাকে দেখে ভালাে লাগাই স্বাভাবিক। শােভনলালের ভালাে লেগে গিয়েছিল কিন্তু মুখচোরা ছেলে, নিজের দুর্বার প্রেম সংগুপ্ত রেখেছিল নিজের মনে—এমনকি লাবণ্যর নিকট আভাসেও ধরা পড়েনি কোনােদিন। লাবণ্যর একটি অনাদৃত ফটোগ্রাফ দেখে সে সযত্নে এঁকেছিল একটি ছবি। পিতার কাছে সে ছবি ধরা পড়তেই পিতার তাড়নায় বিদায় নিতে হয় তাকে অবনীশের বাড়ি থেকে। ঘটনাটি শােভনলালকে কতটা আঘাত দিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল এম. এ, পরীক্ষায় লাবণ্যর চেয়ে তার খারাপ ফলে। এই আঘাত ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে লেখক জানালেন— "শােভনলাল যদি কবি হতাে তাহলে হয়তাে সে খাতা ভরে কবিতা লিখতােতার বদলে আপন পরীক্ষা পাসের অনেকগুলাে মােটা মার্কা সে লাবণ্যর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিল।"


শােভনলালের মনে লাবণ্যর প্রতি প্রেম যে কিছুমাত্র স্তিমিত হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রেমচাঁদ, রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য প্রস্তুতির সময় অবনীশের আমন্ত্রণপত্র সে যেভাবে গ্রহণ করে তা বুঝতে পারলে। শােভনলালের মন এই আহ্বানে চঞ্চল হয়ে উঠলাে— “সে ধরে নিলে, এমন উৎসাহপূর্ণ চিঠির পিছনে হয়তাে লাবণ্যর সম্পতি প্রচ্ছন্ন আছে।” কিন্তু লাবণ্য তাকে তীব্র অপমানে ফিরিয়ে দেয়। শােভনলাল ও লাবণ্যর নিকট প্রত্যাখ্যত হয়ে দীর্ঘবিদায় গ্রহণ করে। তবুও রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারণ করলেন- "একদিন শােভনলালকে বরদান করবে বলেই বুঝি লাবণ্য নিজের অগােচরেই অপেক্ষা করেই বসেছিল। শােভনলাল তেমন করে ডাক দিলে না। তারপর যা কিছু হল সবই গেল তার বিরুদ্ধে।"


প্রেমের চেয়ে অহংকার বেশি না হলে লাবণ্যর এইরকম ব্যবহার করা বােধহয় সম্ভব নয়। অথচ শােভনলাল কত তীব্রভাবে ভালােবেসেছিল, সময়ের পলি সঞ্চয় সেই প্রেমের প্রবাহকে যে বিন্দুমাত্র মন্দ গতি করতে পারেনি- সেকথা স্পষ্ট বােঝা যায়, অমিতের সঙ্গে এক নিভৃত ও ঘনিষ্ঠ দিনের আলাপচারিতায়। লাবণ্য তার জীবনে অন্য প্রেমিকের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও যাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল আঘাত করে, পরে একটি উচ্ছল প্রেমিক জীবনে আসা সত্ত্বেও কেমন করে তাকে আহ্বান করল তার বিস্তারিত বর্ণনা গ্রন্থ মধ্যে না থাকলেও শােভনলালের মহত্বই যে লাবণ্যকে অস্থির করে তুলেছিল সে কথা মানতে কোনাে দ্বিধা নেই। লাবণ্যর জ্ঞানতপস্বী বােবা অবনীশও শােভনলালের বাহ্য প্রকাশহীন প্রেমের ব্যাপারে অজ্ঞই ছিলেন। কিন্তু বিলম্বিত লয়ে তাঁর সাতচল্লিশ বছর বয়সে যখন প্রেম এলাে নিঃশব্দ চরণে তখনই তিনি বুঝতে পারলেন শােভনলালের প্রেমের মাধুর্য।


লাবণ্যর সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযােজ্য। শােভনলালকে সে ভৎসনা করতে পারে এই ধারণায় যে, গ্রহণ করলে তাকে সে কৃতার্থ করে দেবাে। অমিতের স্বর্গ-মর্ত পাতালগামী ব্যাপ্ত মনের অনুভূতিতে যেদিন তার হৃদয় জেগেছে সেইদিনই সে বুঝেছে। প্রেমের কি বিশাল জোর থাকলে এভাবেই দূরে সরে থাকা যায়। তাই লাবণ্যর পক্ষে সম্ভবই ছিল না শােভনলালকে বােঝা, যদি না অমিতের প্রেমের পঞ্চমণি তাকে জাগিয়ে দিত। শােভনলালের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তা লাবণ্য অমিতকে এভাবে বােঝাতে সচেষ্ট হয়েছে

“যে আমার দেখিবারে পায়

অসীম ক্ষমায়

ভালােমন্দ মিলায়ে সকলি, 

এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।”


শােভনলালের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপন্যাস মধ্যে অনুভূত হলেও লেখক বেশিরভাগ সময়েই তাকে রেখেছেন আমাদের চোখের বাইরে। সে অনেকখানিই হয়ে ওঠে আমাদের অনুমানের সৃষ্টি। একবার মাত্র প্রত্যক্ষভাবে তাকে আমরা দেখেছি, কিন্তু সেও লাবণ্যর প্রত্যাখ্যানের আঘাত সহ্য করবার জন্য, শােভনলালের জীবনে যা ঘটেছে। একথায় তাকে বলা যায় প্রথমে প্রেমহীনতার প্রত্যাখ্যান, পরে প্রেমময়তায় গ্রহণ। এই সূত্রেই কেটি মিত্তির নামক চরিত্রটির সঙ্গে তার সাদৃশ্য নির্ণয় করা যায়। সবমিলিয়ে বলতে হয়, উপন্যাসের প্রথম থেকে শােভনলালকে ভাগ্যহত অসার্থক বলে মনে হলেও পরিণতি অংশে এসে বােঝা যায় তার মতাে ভাগ্যবান পুরুষ উপন্যাস মধ্যে আর একটাও নেই। লাবণ্য যেভাবে তাকে গ্রহণ করেছে বােধকরি ঈশ্বরের অপার করুণধারা তাদের প্রতি বর্ষিত হতে থাকবে।