দলনী বেগম বঙ্কিমচন্দ্রের অপরূপ সৃষ্টি ; দলনীর পরিচয় ইতিহাসে নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের যে কল্পনা আয়েষা সৃষ্টি করেছিল তাই-ই আর এক পা অগ্রসর হয়ে দলনীকে সৃষ্টি করলো। – আলোচনা করো।

বঙ্কিমচন্দ্রের 'চন্দ্রশেখর', ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। এটি ইতিহাসাশ্রয়ী মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস। বাংলার শেষ নবাব মীরকাসেম-এর বেগমরূপে দলনী চরিত্রের স্বরূপ উপন্যাস মধ্যে উদ্ঘাটিত হলেও দলনী অনৈতিহাসিক চরিত্র। ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর উল্লেখ নেই। অথচ লেখক অতি নিষ্ঠা ও প্রতিভার গুণে দলনীকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন তাতে সহজেই মনে হয় দলনী ঐতিহাসিক চরিত্র।


একনিষ্ঠ পত্নী ও প্রেমিকা রূপে ‘চন্দ্রশেখর' উপন্যাসে দলনী চরিত্রটি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। ইতিহাসের রাজ রাজাদের যে সমস্ত বেগমের পরিচয় আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, দলনী তাঁদের থেকে ভিন্নধর্মী। মীরকাসেমের বেগমরূপে দলনী আত্মপ্রকাশ করলেও তাঁর মধ্যে বাস করতো এক পতিব্রতা ও প্রজাবতী রমণী, সারাক্ষণ যিনি নবাবের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে তৎপর হয়ে উঠতেন। নবাবের মঙ্গলের জন্য এমন কোনো অসাধ্য কাজ নেই যা তিনি নারী হয়ে সাধন করতে পারেন না। সময় বিশেষ তিনি নবাব ও রাজ্যের মঙ্গলের জন্য বিপদকে তুচ্ছ করে অন্তপুরের সুখ বিসর্জন দিয়ে পথে নেমেছেন। তাই তিনি উপন্যাস মধ্যে অনন্যারূপে প্রতিভাত।


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী ঐতিহাসিক উপন্যাস না হলেও তা ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্স রূপে স্বীকৃত। সেখানে লেখক যে আয়েষা নাম্নী নারী চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন তাও অনৈতিহাসিক চরিত্র। অথচ চরিত্রটি ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এমনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, ইতিহাস থেকে তাঁকে কোনোমতেই আলাদা করা সম্ভব নয়। এই আয়েষাও ছিলেন একজন একনিষ্ঠা সাধ্বী প্রেমিকা। একদা তিনি বিধর্মী মুসলমান রাজার নিকট সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন বন্দি প্রেমিক রাজপুত্রকে নির্দেশ করে—“ওই বন্দি-ই আমার প্রাণেশ্বর।” বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে আয়েষা তাঁর এই ঐকান্তিক প্রেমের মাহাত্ম্যে আজও অসামান্যারূপে খ্যাত। তবে সেখানে আয়েযার বিচরণক্ষেত্র ছিল স্বল্প। সম্পূর্ণরূপে বোধ করি তাঁকে ধরা যায়নি। আলোচ্য উপন্যাসে এসে দলনী আচার আচরণ সহজেই মনে করিয়ে দেয় আয়েষার কথা। এখানে দলনীর বিচরণক্ষেত্র স্বল্পময় বিস্তৃত। তাই দলনীকে আয়েষার বৃহৎ সংস্করণ রূপে চিহ্নিত করা অসমীচীন নয়।


চন্দ্রশেখর উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে সর্বপ্রথম দলনীর সাক্ষাৎ মেলে। সবে বাংলা, বিহার ও ওড়িয়ার নবাব মীরকাশেম মুঙ্গেরের দূর্গে বসতি করছেন। দূর্গমধ্যে অন্তপুরে, দলনী বেগম অপরূপ সাজে সজ্জিতা হয়ে, সুন্দর শয্যা রচনা করে নবাবের আগমনের অপেক্ষায় বিরহে কালযাপন করছেন। নবাবের আসতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে তাঁর মনে ক্ষোভ জন্মায় – “কেন আসিবেন? হাজার দাসীর মধ্যে আমি একজন দাসীমাত্র, আমার জন্য এতদূর আসিবেন কেন?” অবশেষে দলনীর নিকট নবাবের আগমন ঘটল। নবাবকে কাছে পেয়ে দলনী স্ত্রীরূপে তাঁর যথাযথ পরিচর্যায় আত্মনিয়োগ করলেন। অতঃপর যথাসময়ে তিনি নবাবকে ইংরাজদের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হতে নিষেধ করেন। দলনী নিখাদ প্রেমের অধিকারিনী, প্রেমিকা স্ত্রীরূপে প্রেমাস্পদের মঙ্গলকামনায় যতখানি উৎকণ্ঠা প্রকাশের প্রয়োজন ততখানি তিনি করেছিলেন, এই নিষেধের মধ্য দিয়ে।


মুঙ্গেরের নিকটস্থ গঙ্গার ঘাটে সেনাপতি গুরগম খাঁ কর্তৃক দুখানি ইংরাজ নৌকা আটক করা হয়েছে, এ সংবাদ দলনীর নিকট পৌছাতেই অজানা বিপদাশংকায় ভেঙে পড়েন। ইংরাজদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী জেনে নিয়ে এ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে তিনি দাসী কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে অন্তঃপুর ত্যাগ করে পথে নামেন। এসে হাজির হন গুরগন খাঁর ডেরাতে। তিনি এসেছেন গুরগন খাঁকে নিষেধ করতে যেন ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হন। কেবলমাত্র দলনীর এই পথপরিক্রমা নবাবের মঙ্গলকামনায়। দলনী জানতেন না যে নবাবের জন্য তিনি আজ পথে পা বাড়িয়েছেন, সেই নবাবই একদিন তাঁকে ভুল বুঝে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা দেবেন। তিনি যখন অন্তঃপুর থেকে কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে গুরগন খাঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন তখনই বিধাতা বোধ করি দলনীকে দুঃখের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছিলেন। দলনী কেন্দ্রিক পরবর্তী ঘটনাধারায় অন্ততঃ তেমনটি প্রমাণ দেয়।


ইংরাজরা রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে আক্রমণ করে প্রতাপ ও শৈবালিনীকে ধরে নিয়ে যেতে এসে দলনী ও কুলসমকে ভুলবশত নিয়ে গেলে সেইদিন হতে দলনীর ভাগ্যাকাশে বিষাদের কালো মেঘ জড়ো হতে শুরু করেছিল। দলনী বিধর্মীর হাতে বন্দিনী এই সংবাদ নবাবের নিকট পৌঁছাতে তিনি দলনীকে উদ্ধারের জন্য তকি খাঁকে নির্দেশ দেন। দলনীর সুন্দর রূপের প্রতি তকি খাঁর ছিল গভীর আসক্তি। তিনি দলনীকে উদ্ধারে এসে ইংরাজ সায়েবদের নৌকা আক্রমণ করে যুদ্ধে অমিয়ট ও জনসনকে হত্যা করলেন বটে, কিন্তু দলনীকে পেলেন না। দলনী তখন অন্য নৌকায় অর্থাৎ ফষ্টরের নৌকাতে করে বিপদ সীমার বাইরে চলে গেছেন। ফষ্টর প্রাণ ভয়ে ভীত, দ্রুত নৌকা নিয়ে পলায়নে তৎপর। একটা ছোট্টো নৌকা তাঁর পিছু নিয়েছে দেখে তিনি আশংকা করতে থাকেন ওটি নবাবের নৌকা – দলনীকে উদ্ধার করতে দ্রুত এগিয়ে আসছে। দলনী ফষ্টরের নিকট যখন শুনলেন নবাবের নৌকা তাঁদের পিছু নিয়েছে, তখন তিনি নবাবের সঙ্গে মিলন পিয়াসায় উন্মুখ হয়ে ওঠেন এবং নবাবী নৌকায় যাবেন বলে তিনি ফষ্টরের নিকট অনুমতি নিয়ে নৌকা থেকে নদীতীরে নেমে যান। যদিও দলনীর সকল ধারণা ভ্রান্তরূপে পরিগণিত হয়েছিল, তথাপি তিনি যেভাবে নবাবের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে ইংরাজ নৌকা থেকে নদীতীরে অবতরণ করলেন তাতে তাঁর বিরহিনী দশাকেই প্রকট করে। নবাবের নৌকার কোনো সন্ধান না পেয়ে তিনি নির্জন নদীতীরে বিসর্জিতা হয়েছিলেন। তবে সেই মুহূর্তে এক আগন্তুকের সহায়তায় তিনি মুর্শিদাবাদে রওনা হয়েছিলেন।


বুকভরা আশা নিয়ে দলনী বহু বিপদসংকুল পথ পার হয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে ছিলেন। তিনি নবাবের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন এই স্বপ্ন ছিল তাঁর দু'চোখে। কিন্তু তিনি এমনই দুভাগিনী সকল স্বপ্ন সাধ তাঁর অপূর্ণই থেকে গেলো তকি খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায়। ইংরাজদের নৌকায় দলনীকে না পেয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে তকি খা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তিনি নবাবকে জানান দলনীর অমিয়ট সায়েবের উপপত্নী রূপে বিরাজ করছেন। তিনি নবাবের নিকট ফিরতে চান না। এ সংবাদে প্রেমময়ী পত্নী দলনীকে নবাব বিশ্বাসঘাতনা রূপে কল্পনা করতে থাকেন, এবং তিনি দলনীকে বিষপানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দান করেন। নবাবের দণ্ডাদেশ পেয়ে দলনী নির্বিকার। রাজার হুকুম তিনি সশ্রদ্ধ চিত্তে পালন করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। বিষপানের পর তকি খাঁকে তিনি জানাতে ভোলেননি– “আমি তোমার মতো নিমকহারাম নহি – প্রভুর আজ্ঞা পালন করিয়া থাকি তোমার উচিত অবশিষ্ট পান করিয়া আমার সঙ্গে আইস।” এ কথার মধ্যেই প্রমাণিত নবাবের প্রতি দলনীর কী অটুট ভক্তি। নবাব যখন পরবর্তীকালে জানতে পারেন দলনী নিষ্পাপ – তখন তিনি দলনীর জন্য আর্তচিৎকারে ভেঙে পড়েছিলেন। দলনীর জন্য এই অশ্রুমোচন তাঁকে যথার্থই সতীত্বের মর্যাদা দিয়েছে। এবং উপন্যাস মধ্যে তিনি ব্যর্থ আশাহতা বিরহিনী নারী রূপে পাঠকের নিকট হতে বিশেষ সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।