বঙ্কিমচন্দ্র 'চন্দ্রশেখর' উপন্যাসে ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন অনেক বেশি। কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। এই ঘটনাধারার মধ্যে এমন কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্ত আছে যা ইতিহাসের দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে দেয়।

“বঙ্কিমচন্দ্র 'চন্দ্রশেখর' উপন্যাসে ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন অনেক বেশি। কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। এই ঘটনাধারার মধ্যে এমন কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্ত আছে যা ইতিহাসের দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে দেয়।”– উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করো।


বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর চন্দ্রশেখর উপন্যাসে একটা বিশেষ আদর্শ স্থাপন করেছেন –“বাল্যপ্রণয়ে কোনো অভিশম্পাত আছে।” এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে তিনি প্রতাপ ও শৈবালিনী চরিত্রদ্বয়কে সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন ছোটোবেলায় গড়ে ওঠা প্রেম বড়ো হলে তা বাস্তবায়িত হয় না, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবং তা প্রকট করতে প্রতাপ-শৈবালিনী প্রেমপ্রণয়ের বলয় ত্যাগ করে ভিন্ন জীবনে অনুপ্রবেশ করেছিল। শৈবালিনীর সঙ্গে বিবাহ হল চন্দ্রশেখরের, আর প্রতাপের সঙ্গে বিবাহ হল চন্দ্রশেখরের প্রতিবেশী ভগিনী রূপসীর সঙ্গে। এর জন্য উভয় চরিত্রই আজীবন ব্যর্থতা হাহাকারে নিপতিত হয়েছিল। যথার্থরূপে স্বীকৃতি পেল বাল্যপ্রেম টেকে না।


চন্দ্রশেখর উপন্যাসে বহু ভিন্নধর্মী ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে। প্রতাপ-শৈবালিনীর প্রেম প্রণয়ের দ্বন্দ্বের মাঝে এসে মিলিত হয়েছে ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড চিত্র, ও রাষ্ট্রীক সামাজিক নানান উত্থান-পতন, যা মূল কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট সহায়ক হয়ে উঠেছে। এবং সৃষ্টি করেছে কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্ত যা চকিতে ইতিহাসের দিগন্তকে উন্মোচিত করে দেয়। শৈবালিনীর প্রতাপের প্রতিবেশী কন্যা, তারা দরিদ্র এবং পিতৃহীন প্রতাপ দরিদ্র হলেও শৈবালিনীর সঙ্গে তার বিবাহ কোনোমতেই সম্ভব নয়। অথচ দু'জন বাল্য হতেই প্রণয়ে আবদ্ধ। কার্যত ব্যর্থ আশাহত জীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। দুজনে সর্বসম্মতিক্রমে গঙ্গাবক্ষে গেলেন সাঁতার দিতে, উদ্দেশ্য জলে ডুবে মরা। প্রতাপ কথা রেখেছিলেন, তিনি ডুবলেন, কিন্তু শৈবালিনী ডুবলেন না। তিনি ভাবলেন- “কেন মরিব ? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না। শৈবালিনী ডুবিল না – ফিরিল। সন্তরন করিয়া কূলে ফিরিয়া আসিল।”


প্রতাপ ডুবলেন বটে, কিন্তু তাঁর মরা হল না। অনতিদূরেই নৌকাযোগে ভ্রাম্যমানকারী চন্দ্রশেখরের তৎপরতায় তিনি এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। পরিণতি ফলস্বরূপ দেখা গেল শৈবালিনীর রূপে আত্মহারা হয়ে ব্রহ্মাচর্য ব্রত ত্যাগ করে চন্দ্রশেখর শৈবালিনীকে বিবাহ করেন, আর প্রতাপ শৈবালিনীকে হারিয়ে চন্দ্রশেখরের প্রতিবেশী ভগিনী রূপসীকে বিবাহ করে সংসারী হলেন। লেখক এরপর জানালেন– এই বিবাহের আট বৎসর পরে এই আখ্যায়িকা আরম্ভ হয়েছে। অর্থাৎ এ যাবৎ আমরা যা জেনেছি উপন্যাসের উপক্রমনিকার অংশ থেকে। এরপর শুরু হবে আলোচ্য উপন্যাসের মূল কাহিনি ধারা। স্পষ্টই অনুমিত হয় লেখক কত সুন্দর ও কৌশলের দ্বারা অতি দ্রুত উপন্যাসের মূল বিষয়টি উপস্থাপন করে নিলেন। যা হয়ে উঠেছে তীব্র গতিসম্পন্ন।


উপন্যাসের মূল ঘটনা শুরু হয়েছে নবাব মীরকাশেমের উপপত্নী দলনী বেগমের ভিরহচিত্র সেনার মধ্য দিয়ে। তিনি অস্তঃপুর বাসিনী নবাবের জন্য কালক্ষেপ করছেন তিনি কখন আসবেন। দৃশ্যটি বিশেষ উপভোগ্যতা অর্জন করেছে। তারপর নবাবের আগমন ঘটলে দলনীর উৎকণ্ঠা শুরু হয়। ইংরাজদের সঙ্গে বিরোধ থেকে বিরত থাকতে তিনি নবাবকে অনুরোধ করেন। কারণ, দলনী যে নবাবের মঙ্গলকামনায় নিবেদিত প্রাণা। ইতিহাসের এই খণ্ড দৃশ্যটি উপন্যাসের মূল আখ্যায়িকায় পরবর্তীকালে বিশেষ অপরিত্যজ্য বিধেয় রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।


বিবাহের পর শৈবালিনীকে পেয়ে চন্দ্রশেখর বিশেষ সুখ অনুভব করতে থাকলেও চন্দ্রশেখরের মতো নিরাসক্ত, সংযমী পুরুষকে পেয়ে শৈবালিনীর মতো রূপসী যুবতী যে খুশী হবে না তা বলাই বাহুল্য। অনাদৃতা প্রস্ফুট পুষ্পের মতো শৈবালিনী ভীমা পুষ্করিণীতে স্নান করতে গিয়ে ইংরাজ কর্মচারী ফক্টরের নজরে পড়ে যায়। এবং স্বাভাবিক নিয়মেই রাতের অন্ধকারে ফষ্টর কর্তৃক শৈবালিনী লুণ্ঠিতা হয়ে নৌকাযোগে মুঙ্গের যাত্রা করে। চন্দ্রশেখর ছিলেন মুর্শিদাবাদে, ফিরে এসে তাঁর প্রাণময়ী শৈবালিনীর দুর্দশার খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন, সংসারের ব্যবহার্য যাবতীয় দ্রব্য প্রতিবেশীদের বিলিয়ে দিয়ে সাধের পুস্তকগুলিতে অগ্নিস্ত যোগ করে তিনি সবার অগোচরে নিরুদ্দিষ্ট হন।


দলনী বেগম খবর পেলেন সেনাপতি গুরগন খাঁ মুঙ্গেরের ঘাটে দুখানি ইংরাজ নৌকা আটক করে, ইংরাজদের সঙ্গে প্রায় অঘোষিত যুদ্ধের সামিল হয়েছিল, আসন্ন বিপদাশংকায় তিনি রাতের অন্ধকারে বাঁদী কুলসমকে নিয়ে অন্তপুর ত্যাগ করে গুরগনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি সেই যে সুখ নীড় ত্যাগ করে বাইরের অঙ্গনে পা রেখেছিলেন, আর কোনোদিন সুখী গৃহকোণে ফিরে আসতে পারেননি। এই অংশের গুরুত্ব প্রসঙ্গে লেখক জানালেন- “বিধাতা দলনী ও শৈবালিনীর অদৃষ্ট একত্র গাঁথিলেন।” গুরগনকে তিনি শত অনুরোধ সত্ত্বেও ফেরাতে পারেননি, উপরন্তু নিজেই চিরদিনের জন্য গৃহহারা হলেন। দলনী বেগমের বিষাদময় পরিণতি আমাদের অশ্রুসিক্ত করে তোলে। তাঁর মতো প্রেমময়ী নারী যে এমন দুর্দশায় নিপতিত হবেন তা ছিল স্বপ্নের অতীত। প্রতাপ যখন সুন্দরী মারফৎ জানলেন ইংরাজ কর্তৃক শৈবালিনী অপহ্তা, তিনিও কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ছোটো নৌকাযোগে শৈবালিনীর পশ্চাৎ নিলেন। রামচরণ ও প্রতাপ যেভাবে ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শৈবালিনীকে উদ্ধার করলেন তাতে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ইংরাজদের সঙ্গে এ দেশীয় বাঙালি বীরদের যে প্রায়ই সংঘর্ষের চিত্র উদ্‌ঘাটিত হত তা প্রতাপের সঙ্গে ইংরাজদের যুদ্ধই প্রমাণ দেয়। গভীর বুদ্ধিমত্তায় প্রতাপ শৈবালিনীকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন বটে তবে শেষ রক্ষা হল না, ইংরাজরা অতর্কিতে আক্রমণ করে ঘুমন্ত প্রতাপ ও শৈবালিনী ভ্রমে দলনীকে ধরে নিয়ে যায়, পূর্বোক্ত দলনীরে অস্তঃপুর ছেড়ে নবাবের মঙ্গলকামনায় পথে বের হয়েছিলেন আর ফেরা সম্ভব হয়নি। ইংরাজ কর্তৃক অপহূতা হয়ে তিনি কলঙ্কের শিরোপা মাথায় পরেছিলেন।


প্রতাপ ইংরাজদের হাতে বন্দি এ সংবাদে শৈবালিনী অস্থির হয়ে পড়েন। তিনিও নবাব মীরকাসেমের সহায়তায় ছদ্মবেশে প্রতাপকে ইংরাজদের হাত থেকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট হন। এবং তাঁরা নৌকা থেকে গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ সাঁতার দেওয়ার পর ইংরাজদের নাগালের বাইরে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু শৈবালিনী নিজের কথা ভেবে প্রতাপের সান্নিধ্য ত্যাগ করে সবার অজান্তেই শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যেই আত্মগোপন করেন। তবে বিশেষ মুহূর্তে শৈবালিনী চন্দ্রশেখর কর্তৃক পর্বতগুহায় আনীতা হয়ে স্বামী সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন, এবং সৌভাগ্যবশতঃ কঠোর তপশ্চর্যার পর আবার স্বামীর সঙ্গে বেদগ্রামে ফিরতে সমর্থ হয়েছিলেন।


দলনী বেগম ইংরাজ কর্তৃক অপহূতা হয়েছে, এ সংবাদে আত্মহারা হয়ে নবাব তকি খাঁকে নির্দেশ দেন দলনীকে উদ্ধার করে মুঙ্গেরে নিয়ে যেতে। তকি খাঁ ইংরাজদের হত্যা করে দলনীকে না পেয়ে নবাবের কাছে মিথ্যা সংবাদ দেন– দলনী তখন ইংরাজ সায়েব অমিয়টের উপপত্নী। নিজের প্রেমময়ী পত্নীকে এভাবে দ্বিচারিণী হতে দেখে নবাব তাঁকে বিষপানে মৃত্যু দণ্ডাদেশ দেন। নবাবের আদেশ পেয়ে নিষ্পাপ দলনী বিষপানে আত্মহত্যা করেন। নবাব যখন পরে জানলেন দলনী নিষ্পাপ মিথ্যা প্ররোচনায় তিনি তাঁকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ দিয়েছেন, তখন গভীর শোকে ও কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। এবং তকি খাঁ ও ফষ্টর সায়েবকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করেছিলেন।


পরহিত ব্রতধারী প্রতাপ যখন শৈবালিনীর মুখে শুনলেন– “যতদিন তুমি এ পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার ; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” প্রতাপের বুঝতে বাকি রইল না যে শৈবালিনীর জন্য তিনি জীবন পর্যন্ত বলি দিতে পারেন সেই শৈবালিনী আজ তাঁকে সহ্য করতে পারেন না। আপন সুখের জন্য পূর্ব প্রেমাস্পদকে বলি দিতে চান। প্রতাপ বুঝলেন ইহজীবনে তাঁর আর বেঁচে থাকা অসম্ভব। তৎক্ষণাৎ অশ্বারোহে ছুটলেন রণক্ষেত্রে। আহত হলেন। পরে রমানন্দ স্বামীকে বলেন– “আমার ভালোবাসার নাম– জীবন বিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।” অতঃপর প্রতাপের মৃত্যু ঘটে। রমানন্দ স্বামীর প্রতাপের অমরত্ব কামনা করার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। এইভাবে বিভিন্ন কাহিনির সমাবেশে মূল কাহিনিটি সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং উক্ত কয়েকটি বিশেষ বিশেষ স্মরণীয় মুহূর্তের দ্বারা ইতিহাসের দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তাই একার্যে ‘চন্দ্রশেখর' কথা সাহিত্যের অঙ্গনে ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস রূপে বিশেষ স্বীকৃতি আদায় করেছে।