‘হাঁসুলী কাবে উপকথা'র গঠন বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করাে।

'হাঁসুলী কাবে উপকথা'র গঠন বিন্যাস

‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসে তারাশংকর রাঢ় অঞ্চলের মাটি, মানুষ এবং তাদের অপভ্রংশ ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে এই উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাসের ক্ষেত্রে নদী প্রবাহের ধারাটিই এখানে লক্ষিত হয়। 'কোপাই' নদীর তীরবর্তী মানুষজন এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য। লেখক জানিয়েছেন- "কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক—অর্থাৎ যে বাঁকটায় অত্যন্ত অল্প পরিসরের মধ্যে নদী মােড় ফিরেছে, সেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মতাে।" নদী এখানে বিচিত্র হয়ে ওঠে। আর তাই উপন্যাসের শুরুতে এই কোপাই নদীর বর্ণনা চলে আসে। নদীর উপমায় তিনি দেখেন নদীকে। বলেন- "শ্যামলা মেয়ের গলায় সােনার হাঁসুলী," এরপর নদী তীরবর্তী মানুষজনদের কথা, কিন্তু তার আগে আবাদী জমি, বাঁশবন এবং তারপর দুটি পুকুর এবং পতিত জমি। এখানে যারা বাস করে তাদের মধ্যে কাহার সম্প্রদায় হল প্রধান। এখানকার জীবনযাত্রা নদীকেন্দ্রিক, ভাবনা কেবল চারমাসের- 'আষাঢ় থেকে আশ্বিন'। এইভাবে আনুপূর্বিক কাহারদের জীবনযাত্রা এবং পুরাণ কথার কথক সুচাঁদের বর্ণনা দিতে দিতে লেখক উপন্যাসের প্রথম পর্বের কাহিনি বর্ণনা দেন। এতে আছে পাঁচটি অধ্যায়।


দ্বিতীয় পর্বে আছে-হাসুলী বাঁকের সাধারণ জীবনযাত্রার কাহিনি। বনওয়ারীর জমি কেনার ইচ্ছা, পাখি করালীর রং, বনওয়ারী পাখি আর করালীর সাঙার কথা ভাবে। কালাে শশীর চোখে দেখা যায়— 'কোপাই নদীর দহ।' এভাবে লেখক গ্রাম জীবনের কেন্দ্রে পৌঁছে যান, হাঁসুলী বাঁকের সমাজ জীবনের কথা হয়ে ওঠে স্পষ্ট, তাদের বারােমাস জুড়ে লেগে থাকে নানান পূর্জা-পার্বণ। হাঁসুলী বাঁকের এই বারােমাস্যার মধ্য দিয়ে জীবনযাত্রা প্রবাহিত হয়ে চলে। করালী বাবুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বনওয়ারীকে তেরপল এনে দেয়। পাখির আগেকার স্বামী নয়ান পাখির নাক কামড়ালে তাকে মারধাের করে। তবু বনওয়ারীর মধ্যে একটা ভয়, পাপবােধ জেগেই থাকে। চড়কের পাটায় শুয়ে সে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। সে কাটোয়ায় যাবে, গঙ্গাস্নান করতে। এই পর্বে নটি অধ্যায়।


তৃতীয় পর্বে আছে পাঁচটি অধ্যায়। বনওয়ারীর পাটায় শােয়া, নয়নের মার অভিশাপ, কালােশশীকে দহের জলে ডুবতে দেখে বনওয়ারী আর দেখে গােখরাে সাপ। পরমের আক্রোশ মেটে। সে ছুটে পালায় জঙ্গলে।


চতুর্থ পর্বে, পাগল বনওয়ারীকে কালীদহের ধার থেকে টেনে আনে। পরের দিন কালােশশীর দেহ ভেসে ওঠে। বাতাসের ঘূর্ণি দেখে বনওয়ারীর মনে হয় কালােশশী নিমগাছে বাসা নিয়েছে। সে কালীর মাদুলী ধারণ করে। এপর্বে দুটি মাত্র অধ্যায়।


পঞ্চম পর্বে, গাজনের ঢাক বাজনা দিয়ে শুরু। করালী ঘর তুলতে গেলে বনওয়ারী বাধা দিলে থানায় নালিশ করে করালী ঘর তােলার অনুমতি পায়। বনওয়ারী এবারও চড়ক পাটায় শােয়। উনপঞ্চাশ সালের ঝড়বৃষ্টি এলাে। সাপের কামড়ে মারা যায় পানার ছেলে। মনে হয়, এ বাবা ঠাকুরের দণ্ড। মাথলার ছেলেও মরে সাপের কামড়ে। বাবুদের বিরুদ্ধে নালিশ করে করালী কাহারদের কেরােসিনের কার্ড জোগাড় করে। সুবাসীর সঙ্গে করালীর রং শুরু হয়। আর তাই নিয়ে বনওয়ারীর সঙ্গে করালীর মারামারি। করালী জিতে যায়। বনওয়ারী চায় করালীর ঘরে আগুন দিতে। পাখির কথা শুনতে চেয়ে করালীও সুবাসীর মাথা পাথর দিয়ে হেঁচে দিতে চায়। হুমহঁমে পাখির ডাক শুনে বনওয়ারীর মনে হয় ওরা কালােশশী আর গােপীবালা। ভয়ে হিম হয়ে যায়। জ্ঞান হারায়। এ পর্বে আটটি অধ্যায়।


শেষ পর্বে কোনাে বিভাগ নেই। ষাট দিন বাদে রােগ শয্যা থেকে বনওয়ারী উঠে বসে। তার বােধ হয় না বাঁচলে ভালা হতাে। কারণ, “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শেষ হয়ে গিয়েছে। আর তার বেঁচে লাভ কি?" কালারুদ্রের মন্দিরে বসেছে যুদ্ধের অফিস। তামাম বাঁশ যুদ্ধের বাজারে ঠিকাদাররা কিনে নিয়েছে, যুদ্ধ লেগেছে চারপাশের পৃথিবীতে। করালী এই বাঁশের সন্ধান দিয়েছে, সবাই অবাক হয়। বাবা ঠাকুরের বন নেই। বেল গাছ নেই, তাল গাছের বেড় নেই। চন্দনপুর থেকে হাঁসুলি বাঁক পর্যন্ত পাকা রাস্তা করেছে। তাই অনেক দুঃখে পাগল গান ধরে- "হাঁসুলী বাঁকের কথা বলব কারে হায়।" উপন্যাসের শেষাংশে আছে করালী বালিতে গাঁইতি চালায়। নতুন করে কাহার পাড়া গড়বে- "উপকথার কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পথ কাটছে। নতুন হাঁসুলি বাঁক।"


মূলত উপন্যাসের শেষে উপকথার সঙ্গে ইতিহাসের মিলন সূত্রটি লেখক গাঁথতে চেয়েছেন। তাই যে উপন্যাস শুরু হয়েছিল উপকথার আবহ সৃষ্টি করে তা শেষ হয় ইতিহাসের ঘটনায়। এছাড়া উনপঞ্চাশের ঝড়-বৃষ্টি প্রসঙ্গ, যুদ্ধের উড়ােজাহাজ প্রসঙ্গ, যুদ্ধের সময়ে কেরােসিন প্রসঙ্গ, যুদ্ধের বাজারে জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি, ঠিকাদারদের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া ও অরণ্য সম্পদ নষ্ট করা, বাশের ঘটঘট শব্দ ও যুদ্ধের চিত্ররূপ দেবতার মন্দিরকে যুদ্ধের অপিস করা পাকা রাস্তা তৈরি। মােটর গাড়ী গ্রামে ঢুকে পড়া, বন্যা ইত্যাদি বিষয়সহ লেখক ইতিহাসের প্রসঙ্গ এনেছেন এখানে। "বন্যার কথা উপকথা নয়, ইতিহাসের কথা। ১৩৫০ ইংরেজি ১৯৪৩ সালের বন্যা। তেরােশাে পঞ্চাশের যে বন্যায় রেললাইন ভেসে গেল, সেই বন্যা। ইতিহাসে তার কথা।"


তাই বলা যায়—এ কাহিনি যেমন উপকথা তার আদিম সংস্কার দিয়ে শুরু তেমনি শেষের দিকে এসেছে বর্তমানের সঙ্গে তার বিরােধের চরমতম সত্যরূপ ইতিহাসের ঘটনা যার চিহ্ন ধরে রেখেছে। কিন্তু বর্তমানের প্রতিভূ করালী সব উপকথা শেষ হলেও নতুন কাহিনির সূত্রপাত ঘটাতে চায়। ফলে বনওয়ারীর মতাে কেউ কেউ অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সুচাদের বৃদ্ধ চোখ বিস্ফারিত করে সে কাহিনি বলে যায়। এভাবেই চলে জীবন ধারা যা প্রকৃত ইতিহাস হয়ে যায়। এক অর্থে উপকথাও ইতিহাস। যদি তা ব্যাপ্ত হয় তবে তা সার্বিক ইতিহাস হয়ে ওঠে। পরিণতির দিক থেকে এই কাহিনি প্রথমে আটকে ছিল আঞ্চলিকতার ধর্মের বৃত্তে। পরে তা বৃহত্তর বৃত্তে প্রবাহিত হয়। আঞ্চলিক বৃত্ত বিলীন হয়েছে বহত্তর বৃত্তে। এটাই এ উপন্যাসের গঠন রীতির অভিনবত্ব।