‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে কেতকী মিত্রের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করাে।

‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে কেতকী মিত্রের চরিত্র

কেতকীর প্রসঙ্গ এসেছে উপন্যাসের এয়ােদশ পরিচ্ছেদে অমিতের মুখ দিয়ে, উপন্যাসটির চর্তুদশ পরিচ্ছেদটির নামকরণ হয়েছে 'ধুমকেতু' তা কেটি মিত্তিরকে স্মরণ করেই। লেখক তার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন— "কেটি মিত্রিরের আসল নাম কেতকী...সাধারণ বাঙালি মেয়ের দীর্ঘ কেশগৌরবের গর্বের প্রতি গর্ব সহকারেই কেটি দিয়েছে কাঁচি চালিয়ে....মুখের স্বাভাবিক গরিমা বর্ণপ্রলাপের দ্বারা এনামেল করা। বুকের অনেকখানির অনাবৃত। ...যখন সুমার্জিতনখর রমণীয় দুই আঙুলে চেপে সিগারেট খায় সেটা যতটা অলংকরণের অঙ্গরূপে ততটা ধূমপানের উদ্দেশ্যে নয়।" এমন একটি বিলিতি কৌলিন্যের ঝাঁঝালাে এসেন্স, যখন লাবণ্য ও যােগমায়ার কাছে আসে, তীব্র ভাষায় তাদের অপমান করে, তখনও পর্যন্ত কেটিকে শ্রেণিগত চরিত্ররূপে গ্রহণ করাই স্বাভাবিক। তার প্রতি কোনােরূপ ঘৃণা ও বিরক্তিবােধ না জাগলেও কোনােরকম উৎসাহ মনের মাঝে দানা বাঁধে না।


কেটি আমাদের সচকিত করে হীরের আংটি প্রসঙ্গে, যে হীরের আংটি অমিত একদিন ওকে দিয়েছিল। এক মুহূর্তও সে আংটি কেটি হাত থেকে খােলেনি। সেই আংটি সম্বন্ধে অমিতের কাছে তার জিজ্ঞাসা- "এমন অদ্ভুত করেই যদি হারাবে, সেদিন এত আদরে আংটি দিয়েছিলে কেন। সে দেওয়ার মধ্যে কি কোনাে বাঁধন দিল না।" প্রেমহীন অঙ্গুরীয় উপহারের কথা কেতকী ভাবতে পারেনি, আজ যখন তা প্রমাণ হয়ে যায় তখন সে আংটি হাতে বহন করবার লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আংটি খুঁলে ফেলে কেটি ফিরিয়ে দিয়ে যায়। লেখক জানালেন "আংটি খুলে টেবিলটার ওপর রেখেই দ্রুতবেগে চলে গেল। এনামেল করা মুখের ওপর দিয়ে দরদর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।"


এই প্রথম একটি যন্ত্রণাকাতর মেয়েকে উপন্যাস মধ্যে প্রত্যক্ষ করা গেল—মেকি প্রসাধান, কৃত্রিম জীবনযাত্রা তুচ্ছ করে যার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল এক প্রেমিকা, যে অমিতকে ভালােবাসতে পেরেছিল। অমিতের ভালােবাসা সমস্ত অন্তকরণ দিয়ে কামনা করেছিল। অমিত একটি 'গবর্নেসে'র মােহে জড়িয়ে পড়েছে এবং তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করার জন্যই অমিতের বােন সিসি তার বন্ধু কেতকীকে নিয়ে শিলঙ-এ এসেছে। এই প্রসঙ্গে লেখক কৌতুক করে বললেন- "সর্বনাশের স্রোতে অমিতের ঝুঁটির ডগাটাকে যদি কোথাও একটু দেখা যায়। টেনে ডাঙায় তােলা আশু দরকার। এ সম্বন্ধে তার আপন বােন সিসির চেয়ে পরের বােন কেটির উৎসাহ অনেক বেশি।" এই কেটির অতি আধুনিক বেশবাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক আরও জানালেন— “জীবনের আদ্যলীলায় কেটির কালাে চোখের ভাবটি ছিল স্নিগ্ধ,...প্রথম বয়সে ঠোট দুটিতে সরল মাধুর্য ছিল।"


প্রথম বয়স বলতে আজকের পঁচিশ বছরের কেটি যেদিন ছিল অষ্টাদশী কেতকী। অক্সফোর্ডে তখন অমিতের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কেতকীর। কেতকীর প্রেমমুগ্ধ ছিল একটি পাঞ্জাবি যুবক। অমিত সম্ভবত কেতকীর প্রতি গভীর ভালােবাসার প্রমাণ দেখাতেই বাচ খেলায় সেই পাঞ্জাবি যুবককে পরাজিত করেছিল এবং একটা হীরের আংটি তার হাতে পরিয়ে দিয়ে কানেকানে অমিত বলেছিল-

"Tender is the night

And haply the queen moon is on her throne."


অমিত সেই প্রেমকে অস্বীকার করে লাবণ্যকে বােঝাতে চেয়েছে— “সেদিন যাকে আংটি পরিয়েছিলুম, আর আজ যে সেটা খুলে দিলে, তারা দুজনে কি একই মানুষ।" তবে এর খাঁটি উত্তরটা বােঝাতে সমর্থ হয়েছিল যে অমিতের অনাদরে কেতকী আজ কেটি মিটারে রূপান্তরিত হয়েছে।


সন্দেহ থাকে না, অমিতের অনাদরেই সেদিনকার সরল কেতকী মিত্রকে পরিণত করেছে সাত বছর পরের কেটি মিটারে। এর কারণ অবশ্য খুব দুর্বোধ্য বলে মনে হয় না। লাবণ্য যখন তার প্রতি শােভনলালের অস্ফুট প্রেমের গােপন সংবাদ পেয়েছিল তখন তার হৃদয় ছিল গােপন অহংকারের বর্মে আবৃত। ঠিক তেমনি বাগবৈদগ্ধ্যে নারী হৃদয়ে জয় করবার এক দুর্জয় বাসনা ছিল স্বাতন্ত্র ও অ্যারিস্টোক্যাসির দুর্গে লালিত এক যুবকের। সকলের কাছেই নিজেকে স্বতন্ত্র করবার যে দুর্জয় বাসনা তার ছিল, প্রেমিক হিসাবে নারীকে জয় করবার বাসনাও তার অন্তভুক্ত। তার হৃদয়ে আর যাই থাক, প্রেম ছিল না, কারণ সে জানতাে তার উপযুক্ত পাত্রী তাদের সমাজে নেই- "আপন পরিচয়েই যার পরিচয়, জগতে সে অদ্বিতীয়।" এহেন অমিতের পরিচয়েই কেতকী যে কেটিকে রূপান্তরিত হবে তাতে বিচিত্র কি? অবশ্য লাবণ্য অমিতকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বােঝতে সমর্থ হয়েছে সে কেটির প্রতি যা করেছে তার অনাদর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বিধাতার অমােঘ নির্দেশে অমিত তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত কেতকীকে বিবাহ করতে সমর্থ হয়েছিল এবং কেতকীর প্রেম সার্থকতায় পর্যবসিত হয়েছিল।


প্রসঙ্গক্রমে শােভনলালের সঙ্গে কেতকীর তুলনামূলক আলােচনা প্রসঙ্গে বলা যায় প্রথম জীবনের সরল প্রেম ও তার নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান তাদের দুজনকেই বহন করতে হয়েছে। শােভনলালের দ্বিধা জড়িত নিরুচ্চার প্রেম কি নিষ্ঠুরতায় দলিত হয়েছিল প্রত্যক্ষ বর্ণনায় লেখক তা দেখিয়েছেন। কেতকীর প্রেম অনেক বিলম্বে হলেও লেখক অতীব সযত্নে প্রকাশ করেছেন। তবে কেতকীর দুঃখ একটু বেশি বলতে হবে। কারণ, অমিত তার পাণিপ্রার্থী স্বয়ং হয়ে এগিয়ে এসেছিল। কেতকীর জীবনে অমিতের ঔদাসীন্য প্রত্যক্ষভাবে দেখানাে না হলেও তার পরিণতি কি হয়েছিল তা স্পষ্ট করে দেখাবার জন্য লাবণ্য উপস্থিতি একান্ত কাম্য ছিল। প্রেমের এই প্রত্যাখ্যান শােভনলাল ও কেতকী গ্রহণ করেছিল ভিন্নভাবে। শােভনলাল কোনাে দোষ দেয়নি লাবণ্যকে, কিন্তু ঘর বাঁধার দাম্পত্য জীবনের আশা সে পরিত্যাগ করেছিল। একটা তীব্র-ব্যথা বুকে বহন করে সে তার বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে ঠিক করেছিল, কিন্তু কেতকীর প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। সেটি লাবণ্যর কথায় সুন্দরভাবে মূর্ত হয়েছে। অমিতকে বলেছে- "তােমার মন একদিন হারিয়েছে বলেই দশের মনের মতাে করে নিজেকে সাজাতে বসল।" সবমিলিয়ে কেতকী ও শােভনলাল গভীর অনাদরেই সার্থকতা ফিরে পেয়েছে।