শ্রীকান্ত উপন্যাসের অন্নদাদিদি চরিত্র পর্যালােচনা করাে।

'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের অন্নদাদিদি চরিত্র

শরৎ সাহিত্যের নারীচরিত্রের মধ্যে অন্নদাদিদি বিশিষ্ট এবং বিস্ময়সূচক। লেখক স্বল্প পরিসরে এবং মিথকথনে অতি চমৎকারভাবে অন্নদা দিদির চরিত্রখানি ফুটিয়ে তুলেছেন। তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় শাহজীর পর্ণকুটিরের একপাশে শ্রীকান্তের অন্নদাদিদির বাস। শাহজী অন্নদার স্বামী। শাহজী সাপুড়ে, শাহজী অন্নদাদির বােনের হত্যাকারী। তবু অন্নদাদি শাহজীর সঙ্গেই নীড় বাঁধে, শাহজীকে ঘুটে বিক্রি করে খাওয়ায়, যত্ন করে, আবার গাঁজা কেনার পয়সাও দেয়। ইন্দ্রনাথের অশ্রাব্য গালিগালাজ অন্নদাদি নীরবে সহ্য করে, আপন প্রাণের বিনিময়েও শাহজীর বুনাে গােখরাে সাপ অনায়াসে ঝাঁপিতে পুরে দেয় অন্নদাদি। যে স্বামী প্রহারে প্রহারে অজ্ঞান করে দেয়, সেই স্বামীর হয়ে অন্নদাদিদি ইন্দ্রনাথের কাছে প্রাণভিক্ষা করে। এই হল শ্রীকান্তের অন্নদাদি। তাইতাে শ্রীকান্ত যখন অন্নদাদিকে দেখল তখন বিস্তারিত নেত্র মনে মনে বলে উঠেছিল—"যেন ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি। যেন যুগযুগান্ত ব্যাপী কঠোর তপস্যা সাঙ্গ করিয়া তিনি এইমাত্র আসন হইতে উঠিয়া আসিলেন।"


অন্নদাদি পতিব্রতা নারীর আদর্শস্থল। কোথাও ফাকি ছিল না বলেই কোনাে কিছুতেই ভয় ছিল না অন্নদাদির। তাই ইন্দ্রনাথের কাছে আপন স্বামীর প্রবঞ্চনার কথা ফাঁস করে দিতে সে অকুণ্ঠ। ইন্দ্রনাথের কাছে অন্নদাদি অকপটে বলেছে- "শুধু বিশ্বাস করাে ভাই, আমাদের আগাগােড়া সমস্তটাই ফাঁকি। আর তুমি মিথ্যে শাহজীর পিছনে ঘুরে বেড়িওনা। আমরা মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে, মড়াও বাঁচতে পারিনে, কড়ি চেলে সাপ ধরে আনতে পারিনে।” অন্নদাদির এই অকপােট স্বীকারােক্তি, তাকে না বিশ্বাস করে পারা যায় না। তাই সুচারুভাবে শ্রীকান্ত তার অন্নদাদির স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি- "বা কাঁকালে আটির্বাধা কতকগুলি শুকনাে কাঠ এবং এবং ডান হাতে ফুলের সাজির মতাে একখানা ডালার মধ্যে কতকগুলি শাক-সবজি। পরনে হিন্দুস্থানী মুসলমানীর মতাে জামা-কাপড়-গেরুয়া রং-এ ছাপানাে, কিন্তু মলিন নয়। হাতে দুগাছা গালার চুড়ি। শিক্ষায় হিন্দুস্থানীর মতাে সিদুরের এয়তি চিহ্ন।"


নিজের স্বামী প্রতারক, সেকথা স্বীকার করতে অন্নদাদি কোনােরকম সংকোচ অনুভব করে না। ইন্দ্র যখন অভিমান ভরে তাকেও প্রতারক বলেছে, তখন— তাঁহার মুখখানি কীসের অপরিসীম ব্যথায় ও লজ্জায় একেবারে কালিবর্ণ হইয়া গেছে। কিন্তু শাহজী তার স্বামী বলেই অন্নদাদিদি বাড়ি ছেড়ে এসেছিল সমস্ত কলঙ্ক মাথা পেতে নিয়ে। তাই বােধহয় শাহজীর হাতে নিগ্রহের পর ইন্দ্রনাথের হাতে প্রহৃত শাহজীর জন্য এই রমণীই ক্ষমা ভিক্ষার সুরে বলে ওঠে- “ইন্দ্র, এই আমার মাথায় হাত দিয়ে শপথ কর ভাই, আর কখনাে এ বাড়িতে আসি নে। আমাদের যা হবার হােক। তুই আর আমাদের কোনাে সংবাদ রাখিসনে।” যদিও অন্নদাদি স্বামীর কুকীর্তির কথা ইন্দ্রনাথকে বলে ফেলেছিল তথাপি তার এহেন ব্যবহারে স্বামী নিষ্ঠাই প্রকট হয়ে ওঠে।


শাহজী অবশ্য তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে। সাপের কামড়ে তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তবে আশ্চর্য অন্নাদিদির মন-প্রাণ হৃদয়। যে নারী স্বামীর জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে এক বিন্দুতে নামিয়ে এনেছিল, সেই অন্নদাদিদি স্বামীর মৃত্যুর পরে ইন্দ্রনাথের হাজার অনুরােধ সত্ত্বেও তাদের বাড়ি যেতে রাজী হয়নি। তাঁর আত্মমর্যাদাবােধ এতটাই প্রখর যে স্বামীর ঋণ পরিশােধ না করে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না- স্বামীর ঋণ যে আমার নিজেরই ঋণ। এই ঋণ পরিশােধ করার পর পথ পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে। শ্রীকান্তকে একটি লিখিত পত্রে আশীর্বাদ জানিয়ে বলেছে-

"ভগবান যদি পতিব্রতার মুখ রাখেন,

তােমার বন্ধুটিকেও যেন 

চিরদিন তিনি অক্ষয় রাখেন।"


সে যেজন্য লােক নিন্দিত পথগ্রহণ করেও যথার্থ পাতিব্ৰত্য ধর্মরক্ষা করে এসেছে। তার অন্তরে এই দৃঢ় বিশ্বাস বর্তমান ছিল। এই অর্থে এই বিশ্বাস আত্মমর্যাদা বােধেরই নামান্তর।


অন্নদাদিদি আর পাঁচটা সাধারণ নারীর মতাে তার জীবনের বঞ্চনাকে 'পূর্বজন্মের সঞ্জিত পাপ' হিসাবে মেনে নিয়েছে। তার পিতা শাহজীকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শাহজী অন্নদার বিধবা বােনকে পাপের সাক্ষী থেকে মুক্তি দেবার জন্য তাকে হত্যা করে নিরুদ্দেশ হয়। পরে সাপুড়ের বেশে দেখা দিলে সেই দুশ্চরিত্র স্বামীর সঙ্গে ঘর ছাড়ে অন্নদা। মাথায় স্বেচ্ছায় তােলে কলঙ্কের বোঝা। আর সমাজের সহজ গাণিতিক নিয়মেই অন্নদাদিদির জাত যায়। কারণ তার স্বামী মুসলমান। কিন্তু যেভাবে লেখক অন্নদাদিদির বঞ্চনার চিত্র এঁকেছেন তার সহনশীলতা ও পাতিব্রত্যের কথা ব্যক্ত করেছেন। এ জাতীয় সতীত্বের আদর্শ আধুনিক পাঠক হিসাবে সবার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। মধ্যযুগের নারী জীবনের ভয়াবহতাকে অন্নদাদিদির আত্মত্যাগ নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। এধরনের পতিব্রতা চরিত্র পুরুষশাসিত সমাজের কিছু কৃপমণ্ডুক মানুষের অহংবােধকে চরিতার্থ করতে পারে, কিন্তু হঠাৎ সাহিত্য হিসাবে উজ্জীবিত করতে পারে না।


মূলত মানুষের মনের গভীরে ঔপন্যাসিক তাঁর দৃষ্টিকে বিভিন্ন কোন থেকে প্রত্যক্ষ করেন, শিকড় নামিয়ে দেয় মূলে। চিরে চিরে দেখান মানুষের হৃদয় রহস্যের গহীন অন্ধকার ও আলাের খেলাকে। কিন্তু অন্নদাদির চরিত্রাঙ্কনে এই বিশ্লেষণের অভাবে পাঠক পীড়িত বােধ করে। অর্থাৎ অন্নদাদিদি তেমনভাবে পাঠক হৃদয়কে অধিকার করতে পারে না। এদোষ চরিত্রের নয়, স্রষ্টার। তবে সাহিত্যে যা রূপায়িত হয়, বাস্তব তা থেকে বেশি রূঢ়। তাই অন্নদাদিদির চরিত্র বাস্তবে থাকা সম্ভব নয়। বােধকরি এই কারণে বােধহয় সমস্ত পাঠক হৃদয়ের সহমর্মিতা অপহরণ করে চিরতরে অন্নদাদিদি চলে গিয়েছিল। যার জন্য তার চরিত্রটিকে মনে হয় অসমাপ্ত সঙ্গীতের অপূর্ণ রাগিনী।