চন্দ্রশেখর উপন্যাসে ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের সৃষ্ট ইংরাজ চরিত্রগুলি: ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। উপন্যাসটিকে ইংরাজ সম্পর্কে লেখকের কোন বিশেষ মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছে।

'চন্দ্রশেখর' এ গ্রথিত গৌণ কাহিনিটি প্রধানত গড়ে উঠেছে বাংলার শেষ নবাব মীরকাসেমের সঙ্গে বণিক ইংরেজের সংঘাতকে কেন্দ্র করে। এই সংঘর্ষের বর্ষণসূত্রে উপন্যাসকার বঙ্কিমকে বর্তমান আখ্যায়িকায় কয়েকটি ইংরাজ চরিত্রের অবতারণা করতে হয়েছে। অবশ্য তারা অপ্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাদের আলেখ্য নির্মাণের মাধ্যমে বঙ্কিম এদেশে সমাগত তৎকালীন ইংরেজের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তাতে ইতিহাসের সমর্থন আছে।


একদা ইংরেজরা ভারতভূমিতে পদার্পণ করেছিলেন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি দিলেন। ইংরাজের সাহস ছিল, শৌর্য ছিল, তেজস্বিতা ছিল, উগ্র জাতীয়তাবোধ ছিল– সর্বোপরি তারা ছিল কূট রাজনীতিবিদ। এতগুলি গুণের সমবায় হেতু ইংরাজরা দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিল। সুতরাং ছলে বলে কৌশলে তারা যে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চাইবে তাতে বিচিত্র কী? বণিকবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রখর জাতীয়ভাবে উদ্বুদ্ধ, সাম্রাজ্যলিপ্সু এই ইংরেজের সঙ্গে স্বাধীনচেতা নবাব মীরকাসেমের সংঘর্ষ বাধে। এ হেন বৃটিশের প্রতিভূ লরেন্স, অমিয়ট, গলস্টন ও জনসন– এই চারটি চরিত্র।


সাধারণভাবে সে যুগের ইংরাজ চরিত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে বঙ্কিম মন্তব্য করেছেন– “এইসময়ে যে সকল ইংরেজ বাংলায় বাস করতেন তাঁরা দুইটিমাত্র কার্যে অক্ষম ছিলেন- লোভসংযমে অক্ষম ও পরাভব স্বীকারে অক্ষম। তাহারা কখনো স্বীকার করতেন না যে এ কার্যে অধর্ম আছে, অতএব অকর্তব্য। যাহারা ভারতবর্ষের প্রথম ব্রিটেনীয় রাজ্যস্থাপন করেন, তাঁহাদিগের ন্যায় ক্ষমতাশালী এবং স্বেচ্ছাচারী মনুষ্য সম্প্রদায় কখনো দেখা যায় নাই।” তৎকালীন ইংরাজ এর চরিত্রধর্ম বিষয়ে এখানে বঙ্কিম যে আভাস দিয়েছেন তার আলোকে উপরিকথিত চারজন ইংরাজের চরিত্র পাঠ করা যায়। তাদের লোভ সম্বরণ করতে পারেনি- বাণিজ্যগত অর্থের লোভ, রাজত্ব প্রতিষ্ঠার লোভ। লরেন্স ফষ্টরের অতিরিক্ত আরও একটি লোভ ছিল– সুন্দরী নারীর প্রতি। তার ইন্দ্রিয়বৃত্তি দস্যুতা করেছে, ধর্মাধর্ম বিসর্জন দিয়ে সে কুলবধূকে হরণ করে নিয়ে গেছে। তার স্বেছেচার কোনো সীমা মানেনি।


অদ্ভুত এই ইংরাজের সাহস। বীর্যবত্তা ও সংকল্পের দৃঢ়তা তাদের দুর্জয় করে তুলেছে। কোনো অবস্থায়, সে যতই সংকটপূর্ণ হোক, পরাজয় বরণে তারা অস্বীকৃত। এদেশের মানুষকে কখনো তারা গ্রাহ্য করেনি; বুঝতে পেরেছিল, এদেশীয় লোক তাদের কোনো কাজে বাধা দেবে না, সুতরাং ভারতে রাজ্য স্থাপন তেমন কঠিন কিছুই নয়। ভারতীয়ের কাছে পরাভব স্বীকার করলে বাণিজ্য গোটাতে হবে এই বোধ তাদের ছিল। এরূপ মনোভাব হতে ফষ্টর বলেছে– “ইংরেজ হইয়া যে দেশি শত্রুকে ভয় করিবে তাহার মৃত্যু ভালো।” ব্রিটিশের রাজ্যলিপ্সা যে লেলিহান সেনা বিস্তার করছে নবাবের তা অবিদিত ছিল না। দলনীকে তিনি বলতেন– “তুমি বালিকা, ইংরেজ যে কী তাহা তুমি জান না।” জনসন গলস্টনের বাক্যের আচরণে নবাবের এই ইঙ্গিতের যথার্থ প্রমাণ আছে। প্রতাপকে বন্দি করতে গিয়ে তারা দরজায় ঘা দিল, দুয়ার খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে চিত্তের অস্থৈর্য বশে জনসন বলে উঠল– “অপেক্ষা কেন লাথি মার, ভারতবর্ষের কপাট ইংরেজি লাথিতে টিকিবে না।” উদ্ধত ব্রিটিশের পদাঘাতে কপাট ভেঙে গেল। প্রতাপের গৃহে প্রবেশ করবার সময় তারা বলল– "এইরূপে ব্রিটিশ পদাঘাতে সমস্ত ভারতবর্ষ ভাঙিয়া পড়ুক।"


মুসলমান সৈন্যের আক্রমণ এড়াবার উদ্দেশ্যে অমিয়টকে যখন অনুরোধ করা হল যে, একটু দূরে নৌকা সরিয়ে নিয়ে গেলে ভালো হয়। তখন উত্তরে সাহসী অমিয়ট বলেছে – “যেদিন একজন ইংরেজ দেশি লোকে ভয়ে পলাইবে সেদিন ভারতবর্ষে ইংরাজ সাম্রাজ্য স্থাপনের আশা বিলুপ্ত হইবে।” ইংরাজের অস্ত্রবাহী নৌকা আটক করা হয়েছে, ইংরাজরা নবাব সেনার কবলে পড়েছে, তারা আসন্ন মৃত্যুর মুখে। এরূপ একটি পরিস্থিতিতে একজন মুসলমান অমিয়টকে বলল– 'কেন মরিবেন, আমাদের সঙ্গে আসুন।' তখন অমিয়টের প্রত্যুত্তর- “মরিব, আমরা আজ এখানে মরিলে ভারতবর্ষে যে আগুন জ্বলিবে, তাহাতে মুসলমানের রাজ্য ধ্বংস পাইবে। আমাদের রক্তে তৃতীয় জর্জের রাজপতাকা তাহাতে সহজে রোপিত হইবে।” যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরাজরা আত্মসমর্পণ করলো না, মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিল। প্রখর জাতীয়চেতনা, আশ্চর্য সাহসিকতা, তাদের দুর্ধর্ষ করে তুলেছে। সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ভারতের মাটিতে যারা পা দিয়েছে তারা কাপুরুষের মতো মরবে তা অসম্ভব– প্রাণের বিনিময়ে রাজ্যবিস্তারই তাদের লক্ষ্য। ফলে একদিন ভারতে বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিল।


এ হেন ইংরাজের পাশে বঙ্কিম দেশীয় লোকসাধারণের চরিত্রস্বরূপটি তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশের ঐশ্বর্যের জৌলুস এ দেশের মানুষের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে। এই ঐশ্চর্যের লোভে অনেক বাঙালি মেয়ে ইংরাজ ভজনা করেছে, সেকালের বহু ইংরেজ চিত্ত প্রলুব্ধ বাঙালির মেয়েকে নিয়ে এদেশে দুদিনের সংসার পেতেছে। কুঠিয়াল সায়েব ফষ্টরের ধারণা ছিল, বিত্তের প্রলোভনে শৈবালিনীও সহজে তার কাছে ধরা দেবে। অবশ্য সাহেবের সে ভুল পরে ভেঙেছে। সে যুগে বাঙালি কেমন যেন হীনবীর্য হয়ে পড়েছিল, দেশাত্মবোধের অভাব ও সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি তার নৈতিক বল নিঃশেষে হরণ করে নিয়েছিল। সাহস নেই, পৌরুষ নেই, আত্মমর্যাদাজ্ঞান নেই–বাঙালির অস্থিমজ্জায় তখন কেবল ভীরুতা হীনতা প্রবেশ করেছে। কূটকৌশলী ইংরেজ তা বুঝতে পেরেই উদ্ধত হয়ে উঠতে সাহস পেয়েছে। দেশের মানুষের সহায়তায়, দেশের মানুষের চোখের ওপর চন্দ্রশেখরের বাড়ি চড়াও হয়ে একজন ফিরিঙ্গি গৃহবধূ শৈবালিনীকে চুরি করে নিয়ে গেল। আশে-পাশের প্রতিবেশীরা একটি প্রতিবাদ বাক্য উচ্চারণ করলো না। এটি অদ্ভুত ঘটনা হলেও বাস্তব সত্য। জাতির চরিত্রবল থাকলে নবাব মীরকাসেমকে ব্রিটিশের কাছে পরাভব স্বীকার করতে হতো না। বাঙালির কাপুরুষতা, তার নৈতিক শক্তির শোচনীয় অধঃপতন দেশপ্রেমিক জাতিবৎসল বঙ্কিমের চিত্তদেশটিকে লজ্জায় ও গ্লানীতে ভরে তুলেছে। মনে হয়, কিছুটা এই লজ্জা ও গ্লানী মোচনের জন্যই বঙ্কিম উদয়নালার যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালি প্রতাপের শৌর্যসাহসের উজ্জ্বল অভিব্যক্তি দেখিয়েছেন। সবমিলিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরাজের ঔদ্ধত্য ও বিশ্বগ্রাসী দিকটিকেই প্রকট করেছেন উপন্যাসমধ্যে।