শ্রীকান্ত উপন্যাসের রাজলক্ষ্মীর চরিত্র পর্যালােচনা করাে।

'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের রাজলক্ষ্মীর চরিত্র

উপন্যাসে প্রথম রাজলক্ষ্মীকে আমরা পাই অষ্টম পরিচ্ছেদ পিয়ারী বাঈজীবৃপে, কুমার বাহাদুরের শিকার পাটিতে। প্রথম দর্শনে শ্রীকান্ত না চিনলেও পিয়ারীর এক মুহূর্ত সময়ও লাগেনি তার কান্তদাকে চিনতে যাকে কৈশােরেই মনপ্রাণ অর্পণ করেছিল। শ্রীকান্তকে মন দান করার সময় রাজলক্ষ্মী ছিল ৮/৯ বৎসরের বালিকা। দরিদ্রের কন্যা, তার ওপর রােগা-শীর্ণা। শ্রীকান্ত তাকে স্নেহকরা দূরে থাকা, উপরন্তু তার প্রতি অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করত। বুঝতেই পারে নি 'নারীর মনটা' একটা 'বিরাট অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার'। জানতে পেরে বিস্মিত হয়েছে-

"কবে যে এই পিলে রােগা মেয়েটা তাহার ধামার মতাে পেট এবং কাঠির মতাে হাত-পা লইয়া আমাকে প্রথম ভালােবাসিয়াছিল, এবং বৈইচি ফলের মালা দিয়া তাহার দরিদ্র পূজা সম্পন্ন করিয়া আসিয়াছিল, আমি টের পাই নাই।"


শ্রীকান্ত সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছে এই ভেবে যে বহু ঝড় ঝঞ্জার মধ্যেও বাল্যপ্রেমের স্মৃতিই আজ রাজলক্ষ্মীর অন্তরের অন্তরতম স্থলে অবস্থিত।


"কিন্তু এই বস্তুটি, যাহাকে সে তাহার ঈশ্বরদণ্ড ধন বলিয়া সগর্বে প্রচার করিতে ও কুষ্ঠিত হইল না, তাহাকে সে এতদিন তাহার এই ঘৃণিত জীবনের শতকোটি মিথ্যা প্রণয় অভিনয়ের মধ্যে কোনখানে জীবিত রাখিয়াছিল ? কোথা হইতে ইহাদের খাদ্য সংগ্রহ করিত ? কোন পথে প্রবেশ করিয়া তাহাকে লালন-পালন করিত?-"


এই হচ্ছে রাজলক্ষ্মী। এমন ভালােবাসা সেই বাসতে পারে। লৌকিক বহির্জীবনের অন্তরালে চিরন্তন নারীসত্তার অবস্থানই রাজলক্ষ্মীর প্রাণবায়ু।


রাজলক্ষ্মীর দীর্ঘ এবং বিচিত্র জীবন কাহিনিতে দেখা যায় যে, ছােটোতেই সে পিতৃহারা হয়। স্বামী পরিত্যাক্ত মা সুরলক্ষ্মী এবং রাজলক্ষ্মী দুই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। কৌলিন্য রক্ষার জন্য মামা 'দত্তদের বামুনঠাকুর হাবাগােবা ভালাে মানুষের সাথে সত্তর টাকা রফায় দুই ভগ্নীর বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দুদিন পরে টাকা পেয়ে কুলীনবর প্রস্থান করছিল। 'আর কেহ তাহাকে দেখে নাই'। দেড় বছর পরে গ্লীহাজ্বরে সুরলক্ষ্মী মারা যায় এবং আরও দেড় বছর পরে রাজলক্ষ্মী কাশীতে মরে শিবত্ব লাভ করে। জন্ম হয় পিয়ারী বাঈজীর। কুমার বাহাদুরের শিকার পাটিতে রাজলক্ষ্মীকে শ্রীকান্তের চিনতে না পারাটা অসঙ্গত নয়। বাল্যকাল রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে মনে মনে বরমাল্য দান করলেও শ্রীকান্ত সবসময়ই তাকে উপেক্ষা করে গেছে। তা সত্ত্বেও রাজলক্ষ্মীর হৃদয় সে অল্লান। তাই শ্রীকান্তকে তাঁবুতে ডেকে বাড়িসুদ্ধ সবার খবর নেয়। আর বলার ভঙ্গীতে মুহূর্তেই প্রেমের অকুণ্ঠিত অধিকার সম্পন্ন 'সমর্থা' নায়িকার মতাে হয়ে ওঠে।


"কহিল তাহালে যত্নটত্ব করার কেউ নেই, বল। পিসীমার ওখানেই আছাে ত ?

নইলে আর থাকবেই বা কোথায় ? বিয়ে হয়নি, সেত দেখতেই পাচ্ছি, পড়াশুনা করচ? না, তাও ওইসঙ্গে শেষ করে দিয়েচ ?"


একথার পর বিরক্তির সঙ্গে শ্রীকান্তের 'আমাকে চিনলে কি করে'? জিজ্ঞাসার উত্তরে সে যা বলেছে তাতেই বােঝা যায় ভালােবাসার কোনাে গভীরতর অধিকার থেকে স্বতােৎসারিত তার উক্তি-


"কহিল, তােমাকে চিনেছিলাম ঠাকুর, দুবুদ্ধির তাড়ায়-আর কীসে? তুমি যত চোখের জল আমার ফেলেছিলে, ভাগ্যি সূর্য্যিদেব তা শুকিয়ে নিয়েছেন, নইলে চোখের জলের একটা পুকুর হয়ে থাকতাে।"


ভালােবাসার ধর্মই কারণে-অকারণে দয়িত বা দয়িতার জন্য আশঙ্কা। তাই অমাবস্যার রাত্রে ভুতে অবিশ্বাস ও সাহসিকতার দম্ভ প্রদর্শনের জন্য শ্রীকান্তের শ্মশানে যাওয়ার ব্যাপারে সে বাধ সাধেশ্মশানে-টশানে তােমার কোনােমতেই যাওয়া হবে না কোনাে মতেই না.. ভূত-প্রেত কি নেই যে, এই শনিবারের অমাবস্যায় তুমি যাবে শ্মশানে ? প্রাণ নিয়ে কি তাহলে আর ফিরে আসতে হবে ? বলিয়াই পিয়ারী অকস্মাৎ ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। ... এছাড়া কলাকৌশল ও ছলনা করেও শ্রীকান্তকে আটকাতে পারল না। প্রেমাস্পদের নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান ও ঔদাসীন্য সত্ত্বেও নারী স্বভাবের স্নেহকাতরতা ও মাধুর্য ফুটে উঠেছে সুন্দর ভঙ্গীতে। শেষ বাক্য ‘তাকেও কি কথায় ভুলানাে যায়।' এর অর্থও গভীরতর। রাজলক্ষ্মীর প্রেম অন্তরের অন্তরতম স্থলে সেই জন্যই তার মুক্তি নেই। পরকে ভুলানােই তার প্রেমের উদ্দেশ্য হলে সে সত্যি বেঁচে যেত, আত্মসুখে বঞ্চিত হয়ে হা-হুতাশ করত। ওযে মরেছে, ভালােবেসে মরেছে। রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে বলা যায়-

"আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান।

প্রাণের আশা ছেড়ে সপেছি প্রাণ।"


রাজলক্ষ্মীর হৃদয়ের অন্তস্থল আকস্মিক বিদ্যুতালােকে শরৎচন্দ্র দেখেছেন, তাই তাঁর নায়িকা বলতে পেরেছে, 'নিজেই যার বশ হইয়া আছি....।' আর সেইজন্য রাজলক্ষ্মী জীবনসত্যে সঞ্জীবিত। কেবল প্রত্যক্ষকে অনুভব করার যে শক্তি তারই সাহায্যে নারীপ্রেমের জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে তার মধ্যে।


রাজলক্ষ্মীর সেবাপরায়ণ মূর্তির অপূর্ব রূপ দেখতে পাই, দ্বাদশ পরিচ্ছদে। শ্রীকান্ত জানিয়েছে রাজলক্ষ্মী তাকে এক পত্রে নিবেদন করেছিল, "সুখের দিনে না হােক, দুঃখের দিনে তাহাকে বিস্মৃত না হয় এবং তারই শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে শ্রীকান্ত বাড়ি ফেরে। প্রবাদে আছে সন্তান ধারনেই নারী জীবন সার্থক। কিন্তু যে কোনাে কারণেই হােক যে নারীর পক্ষে সংসার করা বা সন্তান ধারণ সম্ভব হয় না সে তার স্নেহতৃয়া কি দিয়ে মেটাবে ? তবে একটা উপায় সে খুঁজে নেয়ই। আমরা আগেই জেনেছি কৌলিন্যরক্ষার জন্য রাজলক্ষ্মীকে তার মামা এমন বরের সাথে বিয়ে দিয়েছিল বিয়ের দুদিন পর থেকে সারাজীবন আর যার সাক্ষাৎ পায়নি এবং পরিস্থিতির প্রতিকূলতার জন্য আজ সে বাঈজী।


কিন্তু সন্তান ক্ষুধা কোথায় যাবে? আমরা দেখেছি সতীনের ছেলে বন্ধুকে কাছে রেখে, পড়াশুনা শিখিয়ে, আদর-যত্ন করে সে ক্ষুধা রাজলক্ষ্মী মেটাচ্ছে এবং শুধু তাই নয় মায়ের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে সে খুব সচেতন। অসুস্থতার পরে শ্রীকান্ত কিছুদিন রাজলক্ষ্মীর ওখানেই বিশ্রাম নিতে চাইলে সে বাধ সাধে—শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর মধ্যে বন্ধুর মা অভ্রভেদী হিমালয়ের মতাে দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহ-মমতা-কর্তব্য পরায়ণতার দিক থেকে অফুরন্ত মাতৃত্বের ভাণ্ডারের অধিকার রাজলক্ষ্মীর মধ্যে ভারতীয় মাতৃমূর্তির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেছে।


সর্বোপরি রাজলক্ষ্মীর যে জীবনেতিহাস পাই তাতে কাশীতেই তার পাট সমাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আত্মসত্তাকে সে লুপ্ত করেনি। সে বুঝেছিল সঙ্গীতের অনুশীলনই রূপােপজীবনী বাঈজীর জীবনে আত্মমর্যাদাবােধের একমাত্র সহায়। সে শুধু হাহাকার নিবারণের জন্য নয়, পরমসুন্দরের আরাধনায় আত্মার তৃপ্তি ও পরিপুষ্টির জন্যও বটে। পতিতা নারী হওয়ার জন্য সমাজে তার স্থান নেই এটা সে বুঝেছিল, তাই প্রচুর ধনসম্পদ উপার্জন করেছিল, কারণ অর্থই শক্তি। তার বিশ্বাস ছিল যে এই শক্তির সঠিক ব্যবহারে সে সমাজকে বশীভূত করতে পারবে এবং পেরেও ছিল। তার এই শক্তির জন্যই সে বন্ধুর মা হতে পেরেছিল। তার বুদ্ধি ও প্রতিভা এক্ষেত্রে তুলনাহীন।


“সে প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাস করে ; সে বিশ্বাস করে, পুরুষের মতাে নারীর পদস্থলনেও ক্ষমা আছে ; নিজের আত্মাকে সে নিজেই উদ্ধার করিবে।”

সে তাে তা পেরেছিল। শ্রীকান্তের উপলখ্ধিতেই এই সার্থকতা আরও স্পষ্ট হয়।

'বড়াে প্রেম শুধু কাছে টানে না দূরে ঠেলিয়া দেয়।'


রাজলক্ষ্মীর চরিত্রে একটা অসাধারণ শক্তি ও অপরিসীম দুর্বলতার অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে। তার শক্তির শেষ নেই, আকাঙ্ক্ষারও শেষ নেই। অনেক বিত্ত সে উপার্জন করেছে, অনেক কিছু হেলায় ত্যাগ করেছে।


"শ্রীকান্তের পাওয়ার জন্য সে সব সম্পদ ত্যাগ করিয়াছে, এবং সেই অশেষ শক্তিশালিনী রমণী তাহার অধিকার লিঙ্সাকেও একেবারে বিসর্জন দিতে চেষ্টা করিয়াছে। তাই সেদিন শ্রীকান্তকে পরিত্যাগ করিতে চাহিল।"


এখানে চরিত্রটি বাস্তব জীবন এবং উপন্যাসের চরিত্র হিসাবে সাথর্ক হয়ে উঠল।