‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যােগমায়া চরিত্রটি সংক্ষেপে নিরূপণ করাে।

‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যােগমায়া চরিত্র

যােগমায়া মানুষ হয়েছিল এমন একটি পরিবারে যেখানে- "মেয়েরা পড়াশুনা করেন, বাইরে বেরােন, এমনকি তাঁদের কেউ কেউ মাসিক পত্রে সচিত্র ভ্রমণ বৃত্তান্তও লিখেছেন।" পড়াশুনার বিধিনিষেধ যেমন ছিল না, তেমনি সংস্কারের চাপও বিশেষ ছিল না, কারণ যােগমায়ার পিতা রামলােচন বন্দ্যোপাধ্যায় অনায়াসে হােটেলে চপ কাটলেট খেতে পারতেন। যোগমায় স্বামী বরদাশংকরের দাদু ছিলেন সংস্কারমুক্ত এক বিদ্রোহী মনের মানুষ। কিন্তু তার নাতিরা হল একেবারে উল্টো। তাঁরা "মনসাকেও হাত জোড় করেন, শীতলাকেও মা বলে ঠাণ্ডা করতে চায়।” এমন যে স্বামী বরদাশংকর, তিনি স্বাধীনচেতা যােগমায়াকে মেনে নেবেন না সেটাই স্বাভাবিক। সমস্ত রকম স্বাধীনতা বিপ্নিত হল তাঁর, পড়াশুনাও নিয়ন্ত্রিত হল- "হাতের ইংরাজি বইগুলাে বাইরেই হত বাজেয়াপ্ত, প্রাগ বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী রচনা ধরা পড়লে চৌকাঠ পার হতে পেত না।”


কিন্তু যােগমায়া বিদ্রোহী মন শাসনে রেখেছিলেন। তাঁর একমাত্র আশ্রয় ছিলেন উদার মনের পুরুষ দীনশরণ বেদান্তরত্ব। প্রকৃত পণ্ডিত মানুষটি তাঁকে পুরাণ উপনিষদের জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা শােনাতেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে স্বামীর মৃত্যু হলে ছেলে যতিশংকর ও মেয়ে সুরমাকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। গরমের সময় থাকেন কোনো একটা পাহাড়ে, অন্য সময় কলকাতা। মেয়েকে পড়াবার জন্যই তিনি খুঁজে পেয়েছেন লাবণ্যকে, প্রথম তাঁকে উপন্যাস মধ্যে পাওয়া যায় এমনভাবে— “চল্লিশের কাছাকাছি তাঁর বয়স, কিন্তু বয়স তাকে শিথিল করেনি কেবল তাঁকে গম্ভীর শুভ্রতা দিয়েছে। গৌরবর্ণ মুখ টস টস করছে। বৈবধ্যরীতিতে চুল ছাঁটা, মাতৃভাবে পূর্ণ প্রসন্ন চোখ ; হাসিটি স্নিগ্ধ।”


অমিতের সঙ্গে যােগমায়ার প্রথম দিনের আলাপ থেকেই বােঝা যায় পরিশীলিত বাক্য ব্যবহারে এবং বাগবৈদম্ধ্যে তিনিও বিশেষ কম যান না। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষা, বিচারবােধ ও ব্যক্তিত্বের চেয়েও তার মেয়েলি দয়া ও ভাবালুতা বেশি সেকথা বােঝা যায় লেখকের একটি মন্তব্য থেকে- "অমিতের সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ হতে না হতেই তিনি ঠিক করে বসে আছেন এদের দুজনের বিয়ে হওয়া চাই।" অথচ অমিত বিবাহের প্রস্তাব করার সময় তিনি এমন একটি কথা বলেছিলেন যে অমিতের মতাে বিশুদ্ধ আধুনিক যুবককেরও তাক লেগে গিয়েছিল তা শুনে। তিনি বলেছিলেন— “ধরেই নাও, লাবণ্যকে তুমি পেয়েইছ, তারপরে হাতে পেয়েও যদি তােমার পাবার ইচ্ছে প্রবল থেকেই যায়, তবেই বুঝব লাবণ্যর মতাে মেয়েকে বিয়ে করবার তুমি যােগ্য।”


বিবাহের প্রস্তাব ওঠামাত্রই লাবণ্যর বিরুদ্ধতা যোগমায়ার ভালাে লাগেনি, কেবল নারী হৃদয়ের সহজাত মমতা দিয়ে নয় যুক্তি দিয়েই তিনি লাবণ্যকে বােঝাবার চেষ্টা করেছেন, লাবণ্য অমিতের স্বভাব জানে বলেই স্বভাবের ওপর অত্যাচার করতে চায় না। যােগমায়া বলেন ভালােবাসাতাে খানিকটা অত্যাচার চায়। লাবণ্য বােঝাতে চায় সে অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে, অমিত নিজের মনের কল্পনা দিয়ে তাকে বিরাট করে তুলেছে বিয়ের পরই সেই কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের আর মিল খাবে না।


যােগমায়া এইসব তত্ত্ব কথার বিরুদ্ধে গিয়ে বলেন— “অনেক পড়ে অনেক ভেবে তােমাদের মন বেশি সুক্ষ্ম হয়ে গেছে ; তােমারা ভিতরে ভিতরে যেসব ভাব গড়ে তুলেছ। আমাদের সংসারটা তার উপযুক্ত নয়।" তবু তিনি বােঝান, অমিতের প্রতি লাবণ্যর যে অকৃত্রিম ভালােবাসা আছে, মিতকে যে না পাওয়ার বেদনা আছে, তার দ্বারাই সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে।


কিন্তু সহজ হয়নি। অমিত চালাচ্ছিল লাবণ্যকে পাবার জন্য তার দুঃখ সাধনা কিন্তু লাবণ্য নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল বসেছিল। মাতৃহৃদয়ের অসীম মমত্ব নিয়ে যােগমায়াকেই এগিয়ে আসতে হয়েছে এবং চার হাতের মিলন তিনি তাঁর সামনে সম্পন্ন করেছেন। এরপর বাকি ছিল শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বিবাহ প্রক্রিয়া। কিন্তু তার আগেই শিলঙ শহরে ঘটে গেল এক ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্প যারা সবচেয়ে বেশি আলােড়িত হয়েছিল তাদের মধ্যে যােগমায়াও আছেন। অর্থাৎ অমিত-কেতকী প্রসঙ্গটি তাঁকে বড়াে বিচলিত করে তুলেছিল।


প্রসঙ্গক্রমে, অবনীশবাবুর চরিত্রে যেমন অসঙ্গতি দৃষ্ট হয় যােগমায়ার চরিণে। ৩ কিয়দংশ অসংলগ্নতা বাসা বেঁধেছে তা উল্লেখ না করে উপায় নেই। যােগমায়া অমিত- লাবণ্যর মিলন সংঘটনে কত বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, অথচ কেতকী প্রসঙ্গে লাবণ্য অমিতের আলােচনায় একবারও এলেন না যােগমায়া, এবং আরও আশ্চর্য তিনি একেবারে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন— প্রয়ােজন ফুরিয়েছে বলে লেখক তাঁকে বিদায় দিয়েছেন। সাত দিন চেরাপুঞ্জি ঘুরে আসবার ছলনায় অমিতকে এড়িয়ে গেলেও শিলঙ থেকে বাসা তুলে নিয়ে যাবার সময় যােগমায়াকে কীভাবে রাজি করায় লাবণ্য! অন্ততঃ একবার বিদায় পর্যন্ত না জানিয়ে চলে যাবার এই নাটকীয়তা যােগমায়া কেমন করে সহ্য করলেন?


আবার, কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজের মেসে থাকে যতিশংকর— 'অসিত তাকে প্রায়ই বাড়িতে নিয়ে আসে, খাওয়ায় তার সঙ্গে নানা বই পড়ে।' কিন্তু যােগমায়া নিশ্চয়ই লাবণ্য ও সুরমাকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকতেন। এতকাছে থাকা সত্ত্বেও যােগমায়াকে অতন্ত একবার দেখা গেল না—অমিত ও লাবণ্য যেভাবে নিজেদের আচরণকে শােভন করে তােলার চেষ্টা করে, যােগমায়াকে একবার এনে সেই শােভনতার কথাও লেখক চিন্তা করলেন না। এই কারণেই অবনীশবাবুর মতােই যােগমায়ার চরিত্রটিকে উপন্যাস মধ্যে উপেক্ষিত তথা অসামাপ্ত চরিত্ররূপে গ্রহণ করতে দ্বিধা জাগে না।