'শেষের কবিতা'র ঐশ্বর্যময় ভাষা তথা সংলাপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পােষণ করাে।

প্রায় অধিকাংশ সমলােচক এক বাক্যে স্বীকার করেছেন 'শেষের কবিতা'র ভাষা তথা সংলাপ অতুলনীয়, অভাবনীয়। সমগ্র উপন্যাসটিতে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভাষার মণিময় দ্যুতি। প্রতিমুহূর্তে চমক, চমকের পর চমক। ভাষার সৌন্দর্যে পাঠক চিত্ত আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিস্তারিত আলােচনা তা সম্ভব নয় বলে এক্ষণে চরিত্রপযােগী স্বল্প সংখ্যক কযেকটি সংলাপ অবলম্বনে এর আংশিক পরিচয় জ্ঞাপন করা যেতে পারে।


১. অমিত- "ফ্যাশানটা হল মুখােশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী"

যারা বিশেষত্বহীন তারাই মেনে চলে ফ্যাসন। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক মানুষ, যারা স্বতন্ত্র, যারা নিজের রুচি অনুসারে চলতে ভয় পায় না—যারা নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র শ্রেণি তৈরি করতে পারে তাদেরই আছে নিজস্ব স্টাইল। অর্থাৎ, স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ওরিজিন্যালিটি, তাকেই বলা যেতে পারে স্টাইল। স্টাইল একজনেরই হয়, ফ্যাশান হয় দশজনের।


২. অমিত— "কিন্তু লিলি, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তােমাতে আমাতে মঙ্গল গ্রহের লাল অরণ্যের ছায়ায় তার কোনাে একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখােমুখী দেখা হয়, আর যদি শকুন্তলার সেই জেলেটা বােয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপ সোনার মুহূর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ চাওয়াচায়ি করব।"


এ কল্পনা রােমান্স নির্ভর। দুষ্মন্তের যে আংটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর শকুন্তলা সম্পর্কে সব কথা দুষ্মন্তের মনে এসেছিল মঙ্গল গ্রহের হাজার ক্রোশী খালে কোনও বােয়াল মাছের পেট চিরে যদি পাওয়া যায় স্বর্গীয় স্যাকা আংঙরারটি, তবে কোটিকোটি বছরের পর অমিত ও লিলি গাঙ্গুলীর যে পরিবর্তনই হােক না কেন তারা এই বিশেষ মুহূর্তটি কথা আবার স্মরণ করতে পারবে।


৩. অমিত- "কমল হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলাের আছে দীপ্তি।"


সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্যা এবং কালচারের পার্থক্য নির্দেশ করা সম্ভব নয়। তবে বিদ্যা অর্জন করা যায় কালচার অর্জন করা যায় না। বিদ্যা কেবল অভ্যাসে আয়ত্ত করা সম্ভব, কালচারের জন্য বংশগত উত্তরাধিকার দরকার। কিন্তু এইজাতীয় বহু উক্তি যা প্রকাশ করতে পারে না, একটি অব্যর্থ উপমায় তার অর্থ বাকবাক করে ওঠে।


৪. অমিত- "কবি মাত্রেরই উচিত পাঁচ বছরের মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। ..যে সব কবি ষাট সত্তর পর্যন্ত বাঁচতে একটু লজ্জা করে না তারা নিজেকে শাস্তি দেয়, নিজেকে সস্তা করে দেয়। শেষকালটায় অনুকরণের দল চারিদিকে ব্যুহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভ্যাংচাতে থাকে।"


রবীন্দ্রনাথ কল্লোলগােষ্ঠীর সাহিত্যিকদের আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের মৃত্যুর পরােয়ানা নিজেই এমনভাবে করেছিলেন। কবির সৃষ্টি ক্ষমতার একটি বিশেষ কালপর্ব আছে- তবে বেশি সময় সৃষ্টি করতে চাইলে রচনার কলেবর বৃদ্ধি হয়, উৎকর্ষ বৃদ্ধি হয় না। অমিতের মুখ দিয়ে লেখক এমনটাই বােঝাতে চেয়েছেন।


৫. অমিত- "সময় যাদের বিস্তর তাদেরই পাঙ্কচুয়াল হওয়া শােভা পায়। দেবতার হাতে সময় অসীম তাই ঠিক সময়টিতে সূর্য ওঠে, ঠিক সময়ে অস্ত যায়। আমাদের মেয়াদ অল্প পাঙ্কচুয়াল হতে গিয়ে সময় নষ্ট করা আমাদের পক্ষে মিতব্যয়িতা।"


অমিত বলতে চায়, মানুষ যখন ইচ্ছা তখনই যদি কোনাে কাজ করতে উদ্যোগী না হয় তাহলে সেই কাজ করার সময় তার জীবনে আর কখনাে আসবে কিনা বলা সত্য কারণ, হাতে সময় তার অপরিমিত নেই। তাই ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ রেখে কাজ করে প্রাণের আনন্দ হারিয়ে লাভ নেই।


৬. লাবণ্য- "তােমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তােমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছিনে, আমার সমস্ত ভালােবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আংটি দিয়াে না, কোনাে চিহ্ন রাখার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন ; বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।"


প্রেমের পরিণতি সাধারণতঃ একটা সামাজিক সম্পর্কে শেষ হয়, যাকে বলে দাম্পত্য বন্ধন। সেইরকম সামাজিক কোনাে বন্ধনের প্রয়ােজনীয়তাও যেমন স্বীকার করে না লাবণ্য, তেমনি একথাও মনে করে না যে, তাদের প্রেমকে অন্তরে জাগিয়ে রাখবার জন্য বাইরের কোনাে বাস্তব অভিজ্ঞানের প্রয়ােজন আছে, তাই সে দাম্পত্য বন্ধন ও চায় না, বাইরের কোনাে স্মৃতি চিহ্ন ও চায় না—অন্তরের প্রেম অন্তরেই জাগরুক থাক চিরদিন, এই তার ইচ্ছা।


৭. অমিত- “সে ভালােবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সময় ; সে ভালােবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব বিন্দুতে মুক্ত হয়ে থাকে, সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।”


মূলত দাম্পত্য জীবনযাপন করতে গেলে, ঘর-সংসার পাততে গেলে বাস্তব জীবনে কাজকর্ম কিছু করতে হয়। জৈবিক প্রয়ােজন ও কিছু থাকে। অমিত বলতে চায় সেই দিকটার প্রয়ােজন মেটাবে কেতকী। তারপর ও যে অবসরের কিছু শূন্য মুহূর্ত সেই মুহূর্তগুলি অসীম প্রেমের আনন্দে ভরে দেবে লাবণ্য।


এমনিভাবেই আরও অসংখ্য মহামূল্যবান উক্তি প্রতুক্তি শেষের কবিতার অবয়ব জুড়ে বিরাজ করছে, যা একাগ্র চিত্তে রুদ্ধশ্বাসে পাঠ করে ক্ষান্ত হওয়া যায় বটে কিন্তু তার তাৎপর্য বিশ্লেষণে বিশেষভাবে বুদ্ধির কসরৎ করতে হয়। এখানেই লেখক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বে কবির শিরােপাধারী যে বক্তব্য কবিতায় জ্ঞান গর্ভ আলােচনায় রাখা সম্ভব তা তিনি আশ্বৰ্যজনকভাবে উপন্যাসের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করে এক অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে রয়েছেন।