'একটি যুগের ঐতিহাসিক শক্তির ঘাতপ্রতিঘাতে ব্যক্তিজীবন কীভাবে আলোড়িত হয় তার ছবি আঁকাই ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার লক্ষ্য।’– ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটি অবলম্বনে এই মতের সমর্থনে অথবা বিপক্ষে তোমার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করো।

চন্দ্রশেখর উপন্যাস সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র একদা মন্তব্য করেছিলেন– “ইহাতে যে সকল ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ আছে, তাহার কোনো কোনো কথা সচরাচর প্রচলিত ভারতবর্ষীয় বাঙ্গালার ইতিহাসে পাওয়া যায় না। 'সয়ের উল মতাক্ষরীণ’ নামক পারস্য গ্রন্থের একখানি ইংরেজি অনুবাদ আছে; ঐতিহাসিক বিষয়ে, কোথাও কোথাও ওই গ্রন্থের অনুবর্তী হইয়াছি।” তা সত্ত্বেও বলতে হয় আলোচ্য উপন্যাসে দলনীর উপাখ্যানটিকে যথার্থ ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর সংযোগ অতি ক্ষীণ। অনৈতিহাসিক চরিত্ররূপে দলনী স্বীকৃত। আর যে দলনীকে নিয়ে নবাব মীরকাশেমের হৃদয় দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তাকে কীভাবে ঐতিহাসিক রূপে কল্পনা করা যেতে পারে?


ইতিহাস থেকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীরকাশেমের সম্পর্কে যে পরিচয় পাওয়া যায় তা থেকে সহজেই বোঝা যায়– “উপন্যাস মধ্যে রাষ্ট্রনীতিক ঘূর্ণাবর্ত আলোড়ন ও ইতিহাস ভিত্তিক ঘটনাবর্ত বিক্ষোেভ চাঞ্চল্যের যে বিবরণী ও বর্ণনা পাওয়া যায় তা ইতিহাসসম্মত।" নবাব মীরকাশেম তো জানিয়েছিলেন ইংরাজরা যে আচরণ করছে তাতে তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি নামেমাত্র রাজা। সকল কর্তৃত্বের ভার ইংরাজদের হাতে। ইংরাজরা তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন– “রাজা আমরা, কিন্তু প্রজা পীড়নের ভার তোমার ওপর। তুমি আমাদিগের হইয়া প্রজাপীড়ন করো।” মীরকাশেম মনেপ্রাণে ভেবে নেন – অনর্থক তিনি প্রজাপীড়ন করে পাপ ও কলঙ্কের ভাগী হবেন না। কারণ তিনি সিরাজউদদৌলা বা মীরজাফর নন। অর্থাৎ মীরকাশেমের এই সিদ্ধান্তই ইংরাজদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এবং কাটোয়া-গিরিয়া উদয়নালার যুদ্ধে ইংরাজের সঙ্গে মীরকাশেমের যে পরাজয় তা ইতিহাসসম্মত।


চন্দ্রশেখর উপন্যাসে উপস্থাপিত চরিত্রসমূহ যেমন– মীরকাশেম, গুরগন, আলি ইব্রাহিম খাঁ, অমিয়ট, এলিস, হেস্টিংস প্রভৃতি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। সেনাদলের পরিচালনায় সোমরু যে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, সেনাদলের ওপর গুরগনের প্রভাব ও তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা, নবাবের প্রতি ইব্রাহিমের আনুগত্য, হেস্টিংসের যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা, অমিয়টের কর্মতৎপরতা প্রভৃতি ইতিহাসভিত্তিক। তবে এই সকল চরিত্রের উপস্থাপনায় লেখক যে সর্বদাই ইতিহাসের আনুগত্য স্বীকার করেছেন তা নয়, কোথাও কোথাও কল্পনারও আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তা কোনো দোষের নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন– “ইতিহাসের সংস্রবে উপন্যাস একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাঁহার কোনো খাতির নাই।” সেদিক থেকে ‘চন্দ্রশেখর' উপন্যাসখানিতে বঙ্কিমচন্দ্র যে যথার্থ ইতিহাস পরিবেশন করেছেন সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।


অষ্টাদশ শতকের রাজনীতিক দ্বন্দ্ব জটিলতায় সমকালীন সমাজজীবনে দেখা দিয়েছিল অনিশ্চয়তা ও অরাজকতা। যথার্থ জাতীয়তাবোধ তখনো মানুষের মনে জাগরিত হয়নি। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চরম ঔদাসীন্য ও নিষ্ক্রিয়তা, ষড়যন্ত্রের কুটিল জালবিস্তার, বিশ্বাসঘাতকতার অনায়াস প্রকাশ প্রভৃতি উপন্যাস মধ্যে বিশ্বস্তরূপে অভিব্যক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে অধ্যাপক শশাংক শেখর বাগচী মন্তব্য করেছেন চন্দ্রশেখর উপন্যাস সম্পর্কে “ইতিহাস এই উপন্যাসখানির কেবল পটভূমিকাই নয়, ইতিহাসের ঘটনা পাত্র পাত্রটির জীবনে দুর্ঘটনা হইয়া দেখা দিয়াছে, যুগসন্ধির এই রাষ্ট্রবিপ্লব পারিবারিক জীবনের মধ্যে প্রবেশ লাভ করিয়া তাহার সুখ-দুঃখ নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে।” রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশজুড়ে যে বিপদের সংকেত ধ্বনিত হয়েছিল তাতে শুধু নবাবের সিংহাসনকে নাড়া দেয়নি, শান্তিময় পল্লীর নিরুদ্বেগ জীবন হতে পল্লিবধূকে সবলে আকর্ষণ করে বিপথে চালিত করেছে, অসূর্যস্পর্শা অসহায়া রাজমহিষীকে পথে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছে, অর্থাৎ রাজনীতির আবর্ত হতে যে হলাহল উৎক্ষিপ্ত হয়েছে তা চন্দ্রশেখর উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের জীব বিষময় করে তুলেছে। উপন্যাস মধ্যে কাহিনিধারায় যে গতিবেগ লক্ষিত হয় তা ইতিহাসেরই পুণ্য অবদান। কেবলমাত্র পরিবেশ সৃষ্টিতে লেখক কাহিনির মধ্যে ইতিহাসকে গ্রহণ করেননি ইতিহাস সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে কাহিনি রচনা করেছে, সাধারণ চরিত্রকে করে তুলেছে অসাধারণ। সব মিলিয়ে উপন্যাসখানিতে যথাযথভাবেই ঐতিহাসিক রস স্ফুরিত হয়েছে।


এতদসত্ত্বেও 'চন্দ্রশেখর' ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। কারণ ঐতিহাসিক উপন্যাস রূপে ‘চন্দ্রশেখর'কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া বঙ্কিমের অভিপ্রায় ছিল না। ঐতিহাসিক তথ্যমালার মালার মধ্যে উপন্যাসে বিধৃত জনজীবন ও সমাজ পরিবেশকে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তার হৃদস্পন্দন অনুভব করাই ছিল লেখকের মূল উদ্দেশ্য। গুরগনের বিশ্বাসঘাতকতা, জনসন-গলস্টনের অটুট পদাঘাত, ফস্টরের অসম সাহসিকতা, অমিয়টের যুদ্ধ, জগৎশেঠের প্রাসাদে নৃত্যগীতের আসর ও তার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের জালবিস্তারের প্রয়াস সমস্তই এমন সুনিপুণভাবে উপন্যাস মধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে যেন এগুলি ইতিহাস-কল্পনা রসে সঞ্জীবিত হয়ে চিরায়ত ইতিহাস কথার মহিমা ও মর্যাদা অর্জন করেছে। কিন্তু তবুও ‘চন্দ্রশেখর' ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। কেন নয় তা পর্যালোচনা সাপেক্ষ।


সমকালীন রাষ্ট্রনীতি পরিবেশের আবহে শুধু মীরকাশের দলনীই বিচলিত চিত্ততার, অস্থিরতার পরিচয় দিয়েছেন মাত্র। ইতিহাসের রথচক্র নবাব ও বেগমের জীবসকল পরিবেশকে পিষ্ট করলেও অন্যান্য চরিত্র – চন্দ্রশেখর-শৈবালিনী-প্রতাপ প্রভৃতির ভাগ্যচক্রকে ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সেখানে ইতিহাসের ভূমিকা সামান্যমাত্র। সেখানে হৃদয়যুদ্ধে নবাব পরাজিত হয়েছেন বটে, ইংরজের কামানের গোলা নবাব শিবিরে পড়েছে সত্য, কিন্তু মীরকাসেম এ সকল তেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। এমন সংকটময় মুহূর্তে মীরকাসেমের চিত্তকে দলনীর অনুভাবনা অধিকার করেছিল। লেখকও এই সময়ে বিশেষ উদাসীনতার পরিচয় দেয়েছেন। তিনি ইতিহাসের এই চরমতম মুহূর্তে দলনী-শৈবালিনীর চারিত্রিক শুচিতা প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং তার প্রমাণ তিনি তথ্যসহ উপস্থাপনা করেন। সেকারণে ইতিহাসের রসস্রোত এই স্থানে মন্দীভূত হয়ে এসেছিল। তৃতীয়ত, মীরকাসেম-দলনী উপন্যাসের অপ্রধান কাহিনি এবং সেই কাহিনিতে সমকালীন ইতিহাস কথার সংযোগ অপেক্ষা বেশি আছে উভয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বন্ধনের প্রসঙ্গ। চতুর্থত, ‘চন্দ্রশেখর' উপন্যাসের মূল কাহিনি, চন্দ্রশেখর-শৈবালিনী-প্রতাপের জীবন মন পরিবেশে যা ঘটেছে তা ইতিহাস বহির্ভূত। যে কোনো ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবেশে তা সংঘটিত হতে পারতো। অর্থাৎ কোনো বিশেষ সময়ের বিশেষ সমাজের, বিশেষ ঐতিহাসিক অধ্যায়ের ওপর তা আদৌ নির্ভরশীল নয়।


সর্বোপরি, ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ‘চন্দ্রশেখর' গ্রন্থে রোমান্সের স্বপ্নজাল বিস্তার করেছে। নতুবা গ্রন্থবর্ণিত অনেক প্রসঙ্গই, যেমন– দলনীর বিষপানে আত্মহত্যা প্রভৃতি কাল্পনিক রূপকথায় পর্যবসিত হোত। রোমান্স সৃষ্টির প্রয়োজনে ঐতিহাসিক উপকরণকে যতখানি গ্রহণ করা যায়, তার সঙ্গে স্রষ্টার সৃজন কল্পনার মিশ্রণে তাকে যতখানি বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপিত করা যায়, লেখক বঙ্কিমচন্দ্র ‘চন্দ্রশেখরকে' তাই করেছেন। এবং ‘চন্দ্রশেখরে’ ইতিহাস ঘটনা প্রবাহে ও চরিত্রসমূহকে প্রভাবিত করলেও তাদের ওপর ইতিহাসের কোনো অনিবার্য নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই অনুপস্থিত। হৃদয়বৃত্তি ও নিয়তি বা ভাগ্য তাদের মূল নিয়ন্ত্রা। কাজেই, এ সকল তথ্য প্রমাণে নির্দ্বিধায় প্রমাণ করা চলে চন্দ্রশেখর, ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, তা ইতিহাসাশ্রিত মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসমাত্র। যার মধ্যে আছে সমাজ পরিবেশের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।