'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসটি মূলতঃ উপকথার জগৎ দ্বারা আবিষ্ট নিজের মতামত সহ ব্যাখ্যা করাে।

সাধারণত একটি মিথিক জগৎ কীভাবে ভজনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের জগতে এলাে তার আখ্যান বৃত্তান্তই তারাশংকরের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'। উপন্যাসের শুরুতে কোপাই নদী ও হাঁসুলী বাঁকের প্রসঙ্গ এসেছে উপমায় চিত্রকল্পে নদীতীরস্থ কাহার মানুষদের সঙ্গে তুলনায় দ্বারা। কাহার পাড়ার এক একটা ঝিউড়ি মেয়ের হঠাৎ ক্রোধ ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার মতােই—ওই ভরা নদী অকস্মাৎ ওঠে ভেসে। তখন একেবারে সাক্ষাৎ ডাকিনী। .. কোপাই নদী ঠিক যেন কাহার কন্যে। তাঁর কন্যার পাপে কুল নষ্ট। লক্ষ্যকরার মতাে, উপন্যাস কিন্তু শুরু হয়েছে অন্য ঘটনায় “হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাত্রে কেউ শিস দিচ্ছে। দেবতা কি যক্ষ কি রক্ষ বােঝা যাচ্ছে। না। সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কাহারেরা।” এই প্রসঙ্গটির পরেই এসেছে। নদীর কথা। ক্রমেই একে একে আত্মপ্রকাশ করেছে শিস্ দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাঁশবনের অন্ধকারে নিহিত কর্তাবাবার জগতের ইতিহাস।


লেখক বারবার উপন্যাস মধ্যে অন্ধকারের কথা উল্লেখ করেছেন। আসলে এ অন্ধকার কাহার জীবনের ; এই অন্ধকারের ইতিহাস লৌকিক অলৌকিক ভরা। হাঁসুলী বাঁকের অলৌকিক জগতের পরিধি বহু বিস্তৃত আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত, প্রেত লােক থেকে নরলােক পর্যন্ত। এর নিজস্ব সৃষ্টিতত্ত্ব আছে—সেই আদি প্রকরণের কাহিনিই যেন সু চাঁদের কথকতায় ফিরে আসে। প্লাবনের রাতে কীভাবে সূচনা হয় এখানকার কাহার জীবনের মিথিক ইতিহাসের। যে করালীকে লেখক হাঁসুলী বাঁকের উপকথাকে ইতিহাসের গঙ্গায় নিয়ে যাবার নায়ক হিসাবে দেখেন, সেই করালীর কত্তাবাবা ও ওই প্লাবনের রাতে গাছের ডালেই জন্মায়। "কত মাতব্বর কাহারদের নিবংশ হয়েছে, কে জানে, কে তার হিসাব রাখে ? কাহার পাড়ার উপকথার কি আদি আছে, না অন্ত আছে ? পিথিমী ছিষ্টি হল, কাহার ছিষ্টি করলেন বিধেতা, কাহারদের মাতব্বরও ছিষ্টি হয়েছে সেইসঙ্গে। বাবা কালারুদ্ধের গাজনের পাটা ঘুরছে বনবাস শব্দে, সেই পাটায় ঘুরে দিন রাত্রি মাস বছর এক এক করে চলে যাচ্ছে, বছর যাচ্ছে, যুগ যাচ্ছে।"


ঔপন্যাসিক কালরুদ্র, কর্তার দৈব নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মানুষী ভগবান-ভগবতীর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। এক অধীন জগৎ এই কাহার পাড়া। যে বন্যাপ্লাবনের বৃত্তান্ত সুঁচাদ শােনায়, তাতে বন্যা নেমে এলে ভয়াবহ অবস্থা। "কুটির সায়েবের চাকর ছিল বেয়ারারা, সয়েব মেম মেরেছে, কুঠি ভেসে গিয়েছে। কে গুরু, কে গোঁসাই তার ঠিকানা নাই। মুনিব নাই। মুনিস নাই অক্ষে করবে কে? আগের কালে বান আসতে, কাহার পাড়া ডুবত, সাহেবরা ছিল—তারা বড়াে বড়াে তক্তা বেঁধে ভেলা করে কাহারদের নিয়ে যেত কুঠি বাড়িতে।... আর এবার কাহারদের পিথিমী অন্ধকার হয়ে গেল, সায়েব মল, মেম মল, কুঠি বিকিয়ে গেল।" তাই উপন্যাসের প্রথমে শােনা গেছে যে একটি অনির্দেশ্য শিস, তাকে নিয়ে কাহারদের মধ্যে দেখা গেছে নানা ধরনের ধর্মীয় ভীত সন্ত্রস্ত পদচারণা। কিন্তু করালী মাতব্বর বনওয়ারীকে অবজ্ঞা করেই এগিয়ে গেছে শিসের আসল রহস্য উদঘাটনে ; ফলে উভয়ের মধ্যে ঘটে যায় মত বিরােধের সংঘাত। যাকে প্রবীণ নবীনের দ্বন্দ্বরূপে আখ্যাত করা হয়। করালীই এই দ্বন্দ্বে জয়ী হয়। কারণ করালীই আগুন জ্বালিয়ে প্রকাণ্ড এক সাপকে পুড়িয়ে, প্রমাণ করে শিসের উৎস কত্তাবাবা নয়, একটা বিষধর সর্প এবং সে মনের আনন্দে চিৎকার করতে থাকে- "দেখে যা তােদের কর্তা পুড়ছে।.. মুরুব্বি কর্তার পূজোটা সব আমাকে দিয়ােগাে।"


আসলে উপন্যাসটি কেবল ক্ষমতার সম্পর্কের সংঘাতে অভিষিক্ত নয়। এতে আঁকা হয়েছে কাহার পাড়ার দৈনন্দিন জীবন, তাদের দুঃখ হর্ষ বিষাদ, উৎসব কলহ চিৎকার সব। আর এই সূত্রেই এসেছে নদী প্রকৃতি। উপন্যাসের আখ্যানে প্রকৃতি বড় ভূমিকা পালন করেছে, বাস্তবে যুদ্ধের বিধ্বংসী আঘাত যতই প্রকট হােক, তাদের চৈতন্যে কর্তা কালারুদ্ধ আর বন্যাই সবকিছুই শেষ করার কারণ কর্তার ক্রোধ, বন্যার তাণ্ডব। উপন্যাসের শুরু থেকেই নদীর নানান রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। নদীর সঙ্গে সাপের তুলনা—কোপাই নদী ঠিক যেন কাহার কন্যে। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবন অরণ্যের মতাে। এই হাঁসুলী বাঁককে নিয়ে লেখক কথক সেজে বারবার শুনিয়ে বলেছেন—লােকবৃত্তান্ত, উপকথা, রূপকথা। তাই প্রকৃতি সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন- "এল হাঁসুলী বাঁকের দেশের কালবৈশাখীর ঝড়। কালাে মেঘের গায়ে রাঙা মাটির ধূলােয় লালচে দোলাই অর্থাৎ চাদর উড়ছে। কালাে কষ্টিপাথরে গড়া বাবা কালারুদ্রের পরনের রক্তরাঙা পাটের কাপড় যেন ফুলে ফুলে উঠছে।"


তবে সর্বনাশী কোপাই কাহারদের জীবনে যতই অমঙ্গল বার্তা বয়ে আসুক না কেন, করালী মধ্যে দিয়ে পরবর্তীকালে কাহাররা সে আধুনিকতার মন্ত্রে উদ্বোধিত হয়েছিল তাতেই রচিত হয়েছে উপকথার পর আর এক ইতিহাস। নসুবালা বার্তা আনে বাঁশবাদির বেড়া ঠেলে বাঁশের কোড়া বেরিয়েছে, কচি কচি ঘাস। প্রকৃতির মার নেই, সময়কে সে উপেক্ষা করতে পারে ; আর ওই প্রকৃতির লৌকিক জড়িয়ে থাকা কাহাররা তৃণমূলের মানুষও প্রকৃতির মতােই দুর্মর, সেও গান বাঁধে—সে ভাঙে তাই সেই গড়ে। আর করালী তার সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, পাখির আঘাতের চিহ্ন মাথায় ধারণ করে হাঁসুলী বাঁকে ফিরছে—সবল হাতে গাঁইতি চালাচ্ছে, বালি ফাটছে, মাটি খুঁজছে। শিকড়ের সন্ধানে করালী তার স্বজগতে আসছে ;এই জগতের রূপান্তরিত রাজপুত্র আজও মাটি খুঁজছে, আজও সে ইতিহাসের গঙ্গার অভিযাত্রী কিন্তু লক্ষ্যে যেতে পারেনি। করালী কখনাে চোড়াই, কখনাে বাখারু হয়ে, কখনাে বসন্ত গর্জনে দৃপ্ত হয়ে হেঁটে চলেছে আজও। তাইতাে বলতে হয় 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা' কাহার জীবনে নাট্যের সংঘটিত রূপে হয়ে শেষ পর্যন্ত লীন হয়েছে এক সার্থক উপকথার জগতে।