বাংলা উপন্যাস ধারায় 'শেষের কবিতা'র যে অভিনবত্ব প্রদর্শিত হয়েছে তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দাও।

'শেষের কবিতা'র যে অভিনবত্ব

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা'য় যে আধুনিকত্ব রচিত হয়েছে তা পর্যালােচনা করাে।


চলিত ভাষার ঐশ্বর্য যে কতখানি, তার অধিকার যে কতদূর বিস্তৃত হতে পারে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত 'শেষের কবিতা'। কিন্তু কেবল ভাষা প্রয়ােগেই শেষের কবিতা উপন্যাসের একমাত্র অভিনবত্ব, একথা কখনােই বলা যাবে না। কল্লোল যুগের কথা সাহিত্যিকগণ সাহিত্যে একটা নতুন যুগ আনবার চেষ্টায় ব্যগ্র ছিলেন, চঞ্চল ছিলেন সাহিত্যে রবীন্দ্রযুগের সমাপ্তি ঘােষণা করতে। শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই রবীন্দ্র যুগের সমাপ্তি ঘােষণা করলেন। এই উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় প্রকাশ্য সভায় বলেছে-


"কবিমাত্রেই উচিত পাঁচ বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়াে নালিশ এই যে, বুড়াে ওয়ার্ডসওয়ার্থের নকল করে ভদ্রলােক অতি অন্যায় রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাস পাঠায়, তবু লােকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে আমাদের কতব ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা।... যেসব কবি ষাট সত্তর পর্যন্ত বাঁচতে একটুও লজ্জা করে না তারা নিজেকে শাস্তি দেয় নিজেকে সস্তা করে দিয়ে। শেষকালটার অনুকরণের দল চারিদিকে ব্যুহ বেঁধে তাদেরকে ভ্যাংচাতে থাকে।"


যতাে লঘুভাবেই বলা হােক, নিজের বিরুদ্ধে নিজের এই বিদ্রোহ কম দুঃখ থেকে আসে না, কম শক্তিরও কাজ নয় এটা। হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, তবু বলি, আমাদের প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাসে রাবণ অতিমন্দ চরিত্রে পরিণত হয়েছেন, নতুবা বলা যেতে পারতাে রাবণ যেমন তাঁর মৃত্যুর জন্য আহত যজ্ঞে নিজেই পৌরহিত্য করার মহত্ব দেখিয়েছেন- রবীন্দ্রনাথের এই মরণােত্সব তারই সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু ব্যাপারটা অবশ্য অন্যভাবে দেখা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম দেখালেন, কেমন করে রবীন্দ্রদ্রোহ করতে হয় ; এবং সেই সঙ্গে এ কথাও প্রমাণ করলেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথই পরেন রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করতে। এখানে রবীন্দ্রনাথ বলতে বােঝানাে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বিশেষ যুগে গঠিত বিশেষ ধারণা।


এই দ্রোহিতা বা উত্তরণ অবশ্য রবীন্দ্র সাহিত্যে নতুন নয়। প্রেম সম্পর্কিত শুচিবায়ুগ্রস্থ মানসিকতার পর্ব পেরিয়ে তিনিই উত্তরিত হতে জানেন সােনার তরীর সৌন্দর্য মুগ্ধতায়। সৌন্দর্য তন্ময়তার পর্ব পেরিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের ঐতিহ্য চিন্তায় নিমগ্ন হতেও তিনিই পারেন। সৌন্দর্যরসিক কবি আধ্যাত্মিক প্রশান্তিতে সমাহিত হতে পারেন এমন মগ্নতায় যাতে বিশ্বের সই বন্দনা করে তাঁকে। আবার আধ্যাত্মিক মােহনায় পৌছে গিয়েও তিনি দিক পরিবর্তন করে বলতে পারেন— "গাঁথব রক্তজবার মালা? হায় রজনীগন্ধা।" এইভাবেই নিজেকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে যেতেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ করেন। শেষের কবিতার অভিনবত্ব এইখানেই যে, নিজেকে অতিক্রম করার যে প্রবণতা অন্যত্র এসেছে সহজভাবে, অনিবার্যতায়—এখানে তা অনেকটা সচেতন প্রয়াস, কিন্তু সে প্রয়াস যে ব্যর্থ হয়নি, কল্লোল গােষ্ঠীর লেখকরাই তা স্বীকার করে নিয়েছেন।


'শেষের কবিতা'র অভিনবত্ব বা আধুনিকত্ব শুধুই এইটুকুই নয়, অমিত রায়ের মধ্য দিয়ে নায়ক চরিত্রের যে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ, সে রূপান্তর শুধু বাহ্যিক নয়, একেবারে প্রকৃতিগত। ভাবপ্রবণ নায়ক-নায়িকা বাংলা কথা সাহিত্যে চিরদিনই আধিপত্য করেছে। কল্লোল যুগের তরুণ লেখকগণ এই প্রথাজর্জর ব্যুহ থেকে মুক্তিলাভের জন্য বাস্তববাদী নায়ক চরিত্র প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। এই ধরনের প্রচেষ্টা বিশেষ সার্থকতা লাভ করেনি এই কারণেই যে যুগান্তর সূচনার মূল তাৎপর্য তাঁরা সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি যদি এক ধরনের রােমান্টিক চিন্তা বলে গণ্য হয় তবে 'বাস্তব' চরিত্র সৃষ্টির একদেশদশী প্রচেষ্টাও সেই একই নামে গণ্য হবার যােগ্য। বস্তুত, অতি অল্প দিনের মধ্যেই যে এক বিশেষ ধরনের গল্প ও বিশেষ ধরনের নায়ক চরিত্র নির্মাণ ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল তা তাঁদের নিজেদের সাক্ষ্য থেকেই জানা যায়। 'কল্লোল' পত্রিকার ১৩৩৩-র ভাদ্র সংখ্যার সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছে- "আজকাল সব গল্পগুলিই প্রায় এক ধরনের আসে। কারখানা ও খনির কুলীদের লইয়া গল্প লেখা এখন সংক্রামক হইয়া দাঁড়াইয়াছে।"


এই বিভ্রান্তিকর অবস্থায় নায়ক চরিত্র সৃষ্টির সঠিক পথ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শেষের কবিতা'য়। অমিত রায় অসামান্য বাক শিল্পী বলে নয়, অসাধারণ প্রণয়ী বলে নয় ; স্বতন্ত্র ও মৌলিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চায় এবং পৃথক রুচির পরিচয় দেয় বলেও নয়—সে মূলত বুদ্ধিবাদী ও নাগরিক মানসিকতার অধিকারী নিজে বিচার না করে কোনাে জিনিসকেই মেনে নেয় না, সত্য বলে গ্রহণ করে না। তার মানসিকতার স্পষ্ট প্রমাণ তার সমস্ত কথাবার্তা। উদাহরণ হিসাবে বিদ্যা ও কালচারের পার্থক্য সম্বন্ধে তার মন্তব্যটি স্মরণ করতে হবে, কারণ তার সমগ্র জীবনই এই কালচারের ছটায় আলোকিত। সে বলেছে- "কমল হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলাে ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলাের আছে, দীপ্তি।"


এছাড়াও স্বাতন্ত্র্য অনুভূত হয় লাবণ্য চরিত্রেও। যদিও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়িকা হিসাবে তার একটি স্পষ্ট ক্ষেেত্র পরিচয় আছে অন্যান্য অনেক বিষয়েই উপন্যাসটি স্বতন্ত্র, প্রাসঙ্গিক ও ধারাবাহিক আলােচনায় সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাই বলতে হয়, প্রতিকূল সময়ের আবর্তে দাঁড়িয়ে এই 'শেষের কবিতা'র সৃষ্টি যে এক অভিনব থা আধুনিকের সুরে অনুরণিত তা স্বীকার করতেই হয়।