“চিন্তার ফলে তাহার জীবন-নদীতে প্রথম বিপরীত তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হইল।” –কার জীবন-নদীতে কী অবস্থায় বিপরীত তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হয়েছে? প্রথম বিপরীত তরঙ্গ বলার কারণ কী? এর ফলে চরিত্রটির কী পরিণতি হল?

শৈবালিনীর জীবন-নদীতে বিপরীত তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হয়েছে। লরেন্স ফষ্টরের নৌকা থেকে অপহ্‌তা শৈবালিনীকে ইংরাজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শৈবালিনীকে উদ্ধার করার অপরাধে প্রতাপ ইংরাজ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে বন্দি হয়েছিলেন। পরে শৈবালিনী নবাবের সহায়তায় ছদ্মবেশে বন্দি প্রতাপকে ইংরাজ নৌকা থেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রতাপ, ও শৈবালিনী ইংরাজ নৌকা থেকে গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে পলায়ন করেছিলেন। তাঁরা গঙ্গার স্রোত-তরঙ্গে সম্ভরণ করাকালিন উভয়ের কথোপকথনের মাঝে বিশেষ মুহূর্তে শৈবালিনীর উপরিউক্ত ধারণাটি প্রতিফলিত হয়েছে।


রাতের অন্ধকারে লরেন্স ফক্টরের সঙ্গে গৃহবধূ হওয়া সত্ত্বেও শৈবালিনীকে গৃহত্যাগিনী হতে দেখে প্রতাপ তাঁকে পাপীয়সী, পাপিষ্ঠা প্রভৃতি ভাবে আখ্যাত করেছিলেন। এমনকি ফষ্টরের নৌকা থেকে উদ্ধারের পর তিনি নিজগৃহে শৈবালিনীকে বলেছিলেন– গুলি করে তিনি শৈবালিনীকে মারতে পারতেন, কিন্তু স্ত্রীহত্যার ভয়ে তা করেননি। সেই প্রতাপ শৈবালিনীর সহায়তায় ইংরাজদের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গঙ্গার বুকে সন্তরণকালে “শৈবালিনী-শৈ” বলে ডেকে উঠেছিলেন। কারণ বাল্যে তিনি শৈবালিনীকে ‘সই’ বলে ডেকে আদর করতেন। সহসা এই ডাকে শৈবালিনী উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আবার প্রতাপকে পেতে কামনা করতে থাকেন। কিন্তু প্রতাপ শৈবালিনীকে নিয়ে আর কোনোরকম অপ্রীতিকর অবতারণা করতে নারাজ। কারণ দুজনেই এখন বিবাহিত। তাই তাঁকে একেবারে চিরতরে ভুলে যাবার জন্যে প্রতাপ শৈবালিনীকে শপথবাক্য পাঠ করতে বলেন। শৈবালিনী প্রতাপের শপথবাক্যে দ্বিধা করতে থাকেন– “তোমার ঐশ্চর্য আছে - বল আছে - কীৰ্ত্তি আছে বন্ধু আছে - ভরসা আছে - রূপসী আছে - আমার কী আছে প্রতাপ?” তথাপি শৈবালিনীর মধ্যে সুমতির উদয় হল। তিনি দেখলেন প্রতাপ তাঁরই জন্য ডুবতে বসেছেন। তিনি সহসা সিদ্ধান্ত নিলেন– “আমি মরি তাহাতে ক্ষতি কী? কিন্তু আমার জন্য প্রতাপ মরিবে কেন?” এই চিন্তার ফলে, শৈবালিনীর জীবন-নদীতে প্রথম বিপরীত তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হতে থাকলো। অর্থাৎ এতদিন তিনি শুধু প্রতাপকে পাওয়ার কামনায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন, আজ প্রতাপের মঙ্গলকামনায় তিনি তাঁকে মুক্তি দিতে তৎপর হয়ে উঠলেন। এইটাই তাঁর জীবন-নদীর বিপরীত তরঙ্গ।


প্রতাপের জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে শৈবালিনী কাউকে না জানিয়ে নৌকা থেকে নদীতীরস্থ অরণ্যমধ্যে অন্তর্হিতা হলেন। জীবনের পাপমোচনের নিমিত্তে প্রায়শ্চিত্যে নিরত হন। এইসময় তিনি নরকদর্শন করেন। শৈবালিনীর এই নরকদর্শন অংশটি বেশ অভিনব উপায়ে উপন্যাসমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। তারপর চন্দ্রশেখরের সহায়তায় তিনি গুহামধ্যে এসে হাজির হন। এইসময় রমানন্দ স্বামীর নির্দেশে তিনি পাপ বিমোচনের জন্য কঠোর ব্রত পালনে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ দু'বৎসর ব্রত উদ্যাপনের পর তিনি চন্দ্রশেখরের সঙ্গে পুনঃ বেদগ্রামে ফিরে এসেছিলেন এবং সুখী দাম্পত্য জীবনের অংশীভূত হন। তবে নরকদর্শন, ব্রত উদ্যাপন, এবং রমানন্দ স্বামীর যৌগিক বলে শৈবালিনী সংসারজীবনে আবার ফিরে এলেও প্রতাপকে তিনি ভুলতে পারেননি। প্রতাপকে জানিয়েছেন- তুমি থাকতে এ জীবনে আমার সুখ নেই। কার্যতঃ শৈবালিনীকে সুখী করতে প্রতাপ রণক্ষেত্রে প্রাণ দিয়ে নিজের ভালোবাসাকে আত্মবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষারূপে আখ্যাত করেছিলেন।