শ্রীকান্ত কি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস- ব্যাখ্যা করাে।

'শ্রীকান্ত' কি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে লেখকের আত্ম উদ্বেলতার থেকে ঔপন্যাসিকের শৈল্পিক চিত্তই প্রধান। এই ধরনের উপন্যাসে বিষয়ের গতি ও পরিণতি নায়কের জীবন গড়ে ওঠার শৈল্পিক তাৎপর্যেই নির্ভরশীল। বক্তার দেশকাল নির্ভর ব্যক্তি স্বরূপের পরিপূর্ণ উন্মােচনেই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের বড়াে সার্থকতা। প্রত্যেক উপন্যাসেই লেখক কম বেশি উপস্থিত থাকেন। তবে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে লেখকের উপস্থিত থাকা তা থেকে স্বতন্ত্র। এই ধরনের উপন্যাসের চরিত্র কেবল পরিচিত জগতের নয়, তারা লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেও একান্তভাবে ঘনিষ্ট থাকে। বাংলা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের সৃষ্টিতে শরৎচন্দ্র পথিকৃত এবং তাঁর শ্রীকান্ত সার্থক ও শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। তবে উপন্যাসের আকারে লিখিত হলেও শ্রীকান্ত, কতকটা আপনার মধ্যে আপনাকে দর্শনের মতাে। গল্প উপন্যাসের কোনাে আদিঅন্ত প্লট এতে নেই। নায়কের জীবনঘটিত কয়েকটি বিচ্ছিন্ন স্মৃতিকথার একটি সংকলনমাত্র। আর সেই ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত স্মৃতিগুলির কয়েকটিকে একটা সূতােয় নতুন করে গেঁথে দিয়েছেন লেখক। তথ্যের সত্যকে তত্ত্বের সত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিভিন্ন তথ্যকে আপন কল্পনার পরশমনির সাহায্যে জীবন্ত ও প্রাণস্পন্দিত করে তুলেছেন।


শ্রীকান্ত উপন্যাসের নায়ক চরিত্র সুদঢ় ও সুস্পষ্ট নয়। ছােটো বড় পরিধির মধ্যে অন্যান্য চরিত্রগুলির নিজ নিজ পরিচয় পরিস্ফুট করে তুলেছেন। লেখক এই চরিত্রগুলিকে তীক্ষ্ণ ও অজ্ঞান দৃষ্টিতে বাইরে থেকে লক্ষ্য করেছেন নিপুণভাবে। নায়ক চরিত্র আমাদের দৃষ্টি থেকে এড়িয়ে গেলেও কাহিনির ঐক্যসূত্র কিন্তু নায়ক চরিত্রেই। একটা সমাজ, তার কিছু দৃঢ়বদ্ধ সংস্কার সামাজিক শক্তির প্রতিক্রিয়া এবং এই সমাজের কিছু নর-নারীর চিত্ত স্ফুরণই 'শ্রীকান্ত' র বিষয়বস্তু। নায়কের বিস্ময়, শ্রদ্ধা, ক্ষোভ, সুগভীর সহানুভূতি এবং হৃদয়ের রাগ বিরাগ রচনাটিকে একটি বিশিষ্ট রূপ দান করেছে। নায়ক যেমন কল্পিত নায়ক নয়, তেমনি আত্মকাহিনির নায়কও নয়। নিজ চরিত্রকে লেখক প্রশংসা বা সমালােচনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।


কাহিনিটিতে লেখক কিছু সজ্ঞান আত্মসমালােচনা করেছেন—সেগুলি শ্রীকান্তের নামে লেখক শরৎচন্দ্রের কথা। তবে তার মধ্যে কিছু কালগত ব্যবধান আছে। মূল শ্রীকান্ত ও লেখক শ্রীকান্তের যথাক্রমে একজনের প্রত্যক্ষ অনুভূতি এবং অন্যজনের পরােক্ষ চিন্তা বা তর্ক সংশয় বিমুক্ত অনুভূতি। একদিকে আছে অজ্ঞান আত্মােঘাটন। অন্যদিকে সজ্ঞান সমলােচনা। অজ্ঞাত আত্মােৎঘাটনে লেখকের আত্মপরিচয় প্রদান, সে পরিচয় কখনাে অন্নদাদিদিতে, কখনাে পিয়ারী বাঈজীতে, কখনাে বা রাজলক্ষ্মীতে অভিব্যক্ত। সর্বপ্রকার বাঁধনকে ভেঙে, শ্রীকান্ত এগিয়েছে। সমালােচকের মতে “এককথায় সে কিছুই শেষ চায় না-অভাবেরও না, সংশয়েরও না। শেষমানেই অস্থিরতার অন্ত, একটা কোনাে খসিয়া পড়া, ইহাই তাহার প্রকৃতি বিরুদ্ধ।” তাই মাঝে মাঝে মনে হয় 'শ্রীকান্ত' অসমাপ্ত কাহিনি এবং তার কারণ শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্রে রূপান্তরিত হওয়া। শ্রীকান্ত অবন্ধন থেকে বন্ধনে অতৃপ্তি থেকে তৃপ্তিতে এবং সমাজ সংসারের বহির্দেশ থেকে অন্তর্দেশ যাত্রা করেছে।


আলােচ্য উপন্যাসে দুটি বিভাগ স্পষ্টত বর্তমান। আত্মপ্রকাশ ও আত্মচিন্তা। আত্মপ্রকাশে আছে আত্ম দর্শন এবং আত্মচিন্তায় আছে আত্মসমালােচনা। মাঝে মাঝে মনে হয় নায়ক শ্রীকান্ত যেন লেখক শরৎচন্দ্র। কেননা শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিজীবন বৃত্তে ঘুরলে দেখা যায় তার বাল্যকাল মাতুলালয়, ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে কেটেছে এবং তিনি প্রকৃতিতে ‘ভরঘুরে'।


বাল্যকালের পড়াশুনা, বন্ধু বান্ধবের সংস্পর্শে আসা, জমিদার মহাদেব শাহুর বন্ধুত্ব মেজদার তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা, ইন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব ও সাহচর্য এবং জমিদার কুমার সাহেব প্রভৃতির প্রসঙ্গ 'শ্রীকান্ত'-এ এসেছে যথাক্রমে। সুতরাং উপন্যাসের ঘটনাগত দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে শরৎচন্দ্রের জীবনের অনেকটাই তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত। পিয়ারী বাঈজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ সন্ন্যাস গ্রহণ প্রভৃতি ঘটনাও বাস্তব সমর্থিত। মজফরপুরের বিচিত্র স্মৃতি পিয়ারীর রাজলক্ষ্মীতে রূপান্তর ঘটনার বাস্তবভিত্তি দেবানন্দপুরের কায়স্থ পরিবারের কিশােরী কন্যা কাশীদাসী, বালক ন্যাড়ার নিত্য সঙ্গিনী উৎপাত উপদ্রব নীরবে সহ্য করা, শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মী বা পিয়ারী বাঈজী—শরৎচন্দ্র এভাবে সাতাশ বছর পর্যন্ত বহু ঘটনা বিবৃত করেছেন আলােচ্য উপন্যাসে। সুতরাং নিঃসন্দেহে এ কাহিনি লেখকের নিজেরই অন্তরঙ্গ জীবনের কাহিনি।


অবশ্য শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত সম্পর্কে সব কৌতুহল নিরসনের চেষ্টা করেছেন। রাজলক্ষ্মী সম্পর্কে বলেছেন বানানাে গল্প, শ্রীকান্ত তিনি নন ইত্যাদি। অথচ প্রথম পর্বের পঞ্চম পরিচ্ছেদে তিনি লিখেছেন : "আমি বেশ জানি, এই যে কাহিনি আজ লিপিবদ্ধ করিলাম তাহাকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে লােক দ্বিধা করিবেই। পরন্তু উদ্ভট কল্পনা বলিয়া উপহাস করিতেও ইতস্তত করিবে না। তথাপি এতটা জানিয়াও যে লিখিলাম ইহাও অভিজ্ঞতার সত্যকার মূল।" অতএব বলা যায়, শ্রীকান্ত আত্মজীবনী ও আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। শ্রীকান্তের আত্মপরিচয় তাঁর শিল্পীসত্তার সঙ্গে মিলে গেছে। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড ঘটনা ও কাহিনি, ঘটনার অন্তরালে ফুটে ওঠা বিভিন্ন চরিত্র একদিকে যেমন শরৎচন্দ্রের পরিচিত ব্যক্তিগত জীবন থেকে উঠে এসেছে, তেমনি সেগুলি শিল্পগত মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। শ্রীকান্তের ব্যক্তিগত অনুভূতি বিশ্বগত অনুভূতির মাত্রা লাভ করেছে।


সবমিলিয়ে বলতে হয় আলােচ্য গ্রন্থে শ্রীকান্তের জবানীতে আমরা শরৎচন্দ্রের চিন্তা সমাজ ভাবনা, নারীর মূল্য প্রভৃতি বিষয়ে মােটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যাই। তাঁর পরিচিতি দেখা জগতের ছবিই তিনি আঁকতে চেয়েছেন। লেখক স্বয়ং বলেছেন "অনেক বলিবার লােভ দমন করিতে হয়, তবে ছবি হয়। বলা বা আঁকার চেয়ে না বলা, না আঁকা ঢের শক্ত। অনেক লােভ দমন করিলে সত্যকারের বলা এবং আঁকা হয়।" এই মন্তব্যে শিল্পী এবং ব্যক্তি দুয়ের দিক প্রকটিত, কাজেই সমালােচক রােজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে সুর মিলিয়ে বলা যায়- "আত্ম কাহিনির ছলেই হােক বা কোনাে নায়ককে স্থাপিত করেই হােক, সাধারণতঃ এ জাতীয় উপন্যাসের ভিত্তি লেখকের জীবনের ছায়াপাত করে বলে পাঠকদের কাছে এদের একটা পৃথক মূল্য আছে।" সুতরাং স্বীকার করতেই হয়, 'শ্ৰীকান্ত আত্মকাহিনি হয়েও উপন্যাস।