শ্রীকান্ত উপন্যাসের সমাজ বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা পােষণ করাে।

'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের সমাজ বাস্তবতা

শরৎচন্দ্র, তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু রুপে বেছে নিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের গ্রাম্য সমাজকে। তাই গ্রাম জীবনের বিভিন্ন চরিত্র এবং সমাজ সম্পর্কে একটি ধারণা তথা সেই সমাজের অনুশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল কথাই ধরা পড়েছে তার বিভিন্ন উপন্যাসে। 'শ্রীকান্ত' এ রাজলক্ষ্মী বাল্যকালে মন দিয়েছিল শ্রীকান্তকে। সময়ে অসময়ে শ্রীকান্তের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছে শ্রীকান্তকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পেয়েও পায়নি। শুধু তার মনকে প্রবােধ দিয়েছে। এই ভেবে— "বড়াে প্রেম শুধু কাছেই টানে না-ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।" সমগ্র শরৎ সাহিত্য জুড়ে বাল্যবিধবা সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই প্রথার বিষবাষ্পে সমাজ যে কতটা জর্জরিত হয়েছিল তার একটা বড়াে প্রমাণ রাজলক্ষ্মীর পিয়ারী বাঈজীতে পরিণত হওয়া।


আবার তথাকথিত হিন্দু সমাজের শিরােমণিরা এই বাল্যবিধবাদের প্রতি যে কতখানি নির্মম ছিল তার প্রমাণ নিরুদিদি, যে নিরুদিদির সেবা গ্রামের প্রতিটি লােকই উপভোগ করেছিল। ত্রিশবছর বয়সে সেই বাল্যবিধবা নিরুদিদি যখন হঠাৎ পদস্থলন হল, তখন হিন্দু সমাজ সেই হতভাগিনীর মুখের ওপর সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তাই- "সুদীর্ঘ ছয়মাসকাল ধরিয়া বিনা চিকিৎসায় তাহার পদস্থলনের প্রায়শ্চিত্ত সমাধা করিয়া শ্রাবণের এক গভীর রাত্রে ইহকাল ত্যাগ করিয়া যে লােকে চলিয়া গেলেন তাহার অভ্রান্ত বিবরণ যে-কোনাে স্মার্ত ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানা যাইতে পারিত।" এখানে সমাজের প্রতি লেখকের ব্যঙ্গের কষাঘাত চাপা থাকেনি। অন্যদিকে অন্নদাদিদির যে পরিণতি তার মূলেও কিন্তু বাল্যবিধবা সমস্যাই দায়ী। কেননা বাল্যবিধবা বােনকে হত্যা করেই তাে তার স্বামী নিরুদিষ্ট হয়েছিল।


কৌলীন্য প্রথার কারণেই সমাজে বাল্যবিধবা সমস্যার সূত্রপাত হয়েছিল। রাজলক্ষ্মীতে ও তার দিদির বাল্যবিবাহ ও বিধবা হওয়ায় কাহিনি সেই সামাজিক আচারেরই বিষময় পরিণতি। কুলীন জামাই দুই বােনকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করলে পর সুরলক্ষ্মী প্লীহা জ্বরে মারা যায় আর রাজলক্ষ্মী কাশীবাস করতে গিয়ে রূপান্তরিত হয় পিয়ারী বাঈজীতে। আবার বিভিন্ন সামাজিক অনুশাসন গ্রাম্য সমাজকে কীভাবে আঁকড়ে ধরেছিল তার বড়াে প্রমাণ অন্নদাদিদির ঘটনা। হিন্দু সমাজে স্বামীনামক যে একটি আইডিয়া আবহমান কাল ধরে প্রচলিত তারই শিকার অন্নদাদিদি। এরই অনুগামী হয়ে সে স্বামীকে দুশ্চরিত্র, খুনি, লম্পট জেনেও তার সঙ্গে ঘড় ছেড়ে মিথ্যা কলঙ্কের বােঝা মাথায় নিয়ে কুলত্যাগিনী হয়েছিল।


সমগ্র হিন্দু সমাজ জুড়ে যে জাতিভেদ বিরাজমান ছিল শরৎচন্দ্র তাকে অবজ্ঞা করে এগিয়ে যেতে পারেননি। তার মন হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী। তাই তাে মড়ার জাতি নিয়ে বালক শ্রীকান্তের মনে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল ইন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে নিজের মনের কথাগুলাে ব্যক্ত করলেন এভাবেই- "আরে এযে মড়া, মড়ার আবার জাত কী? এই যেমন আমাদের ডিঙিটা, এর কি জাত আছে?" এমনতর পরিচয় অন্যত্র পাওয়া যায়। শ্রীকান্ত যখন অসহায় বালিকা গৌরী তেওয়ারীর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে তখন সেই ছােটো মেয়েটি বলে- "আমরা যে তেওয়ারী। আমাদের ঘর ও দেশেতে পাওয়া যায় না।" গৌরী তেওয়ারীর এই ছােটো মেয়ে বাল্যবিবাহ এবং জাতিভেদ প্রথাজর্জরিত বাংলাদেশের সমাজ জীবনের অন্যতম বলি। এই প্রথারই নির্মম ফল তার দিদির মৃত্যু। যদিও শ্বশুর বাড়ির লােকেরা বলেছে যে কলেরায় মরেছে কিন্তু ছােট মেয়েটির মুখ থেকে জানা যায়- "দিদি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছেই।" এমনকি কাঁদতে কাঁদতে সেও শ্রীকান্তকে জানায়- "আমি ও দিদির মতাে গলায় দড়িদিয়ে মরতাম।”


ভবঘুরে শ্রীকান্ত সেই ছােট্ট গৌরী তেওয়ারীর জীবনের যন্ত্রণাদীর্ণ কথাগুলি শুনে মনে মনে ভাবতে শুরু করেছিল— “যে সমাজ এই দুইটি নিরূপায় ক্ষুদ্র বালিকার জন্যও স্থান করিয়া দিতে পারে নাই, সে সমাজ আপনাকে এতটুকু প্রসারিত করিবার শক্তি রাখে না, সে সমাজের জন্য মনের মধ্যে কিছুমাত্র গৌরব অনুভব করতে পরি না।" -এ বক্তব্য যে দরদী লেখক শরৎচন্দ্রের অন্তরস্থিত বাণী সেকথা বলাই বাহুল্য। লেখক এখানেই ক্ষান্ত না থেকে মনে মনে আরও বলেছেন— “ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে এমনি মুদ্রিত হইয়া গিয়াছিল যে এতকাল পরেও সমস্ত স্মরণে রহিয়াছে এবং এই আদর্শ হিন্দু সমাজের সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জাতিভেদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের ভাব আজিও যায় নাই।” এই বিদ্রোহের বাণী বােধ করি তিনি খুব সুন্দরভাবে উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর 'পল্লী সমাজ' উপন্যাসে।


সর্বোপরি বলতে হয়, লেখক মাত্রই সমস্যার কথা উত্থাপন করেন কিন্তু সহজ সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাই, শরৎচন্দ্র উপন্যাসের মধ্যে সমাজ সমস্যাগুলিকে রূপায়িত করেছেন মাত্র। কিন্তু সমস্যা সমাধানের দায়িত্বপালন করেননি। অবশ্য তাঁর চরিত্রগুলি যেসমাজ পরিবেশে লালিত বর্ধিত তাতে যথাযথ সমাধানের পথ নির্দেশ করা অত্যন্ত দুরূহ। তাই দিনের পরদিন বােবা মুখে নির্বাকের মতাে সমাজের অন্ধ কুসংস্কারকে মেনে নেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না। লেখকও সেই পথের পথিক।