'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসে সে জগতের সৃষ্টি হয়েছে যেটি মূলত 'মিথময়'- ব্যাখ্যা করাে।

মিথ হল মুখে মুখে চলা তারিখহীন স্রষ্টাহীন গল্প, যাতে একটা কাল নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলে। মিথের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বাস্তবের অজস্র রেণু, বিপরীতের সংশ্লেষে সেই অন্তলীন অভিজ্ঞতা আমাদের চেতনায় ধাক্কা মারে। সমাজ বিবর্তন, শ্রেণি বৈষম্য, বিজ্ঞান চেতনার সংঘাত এ সবই অবচেতনের কার্যকারিতায় মিথের অন্তর্ভূক্ত। মিথের সঙ্গে ধর্মের ও পার্বণের একটা যােগ আছে। আচার মিলিয়ে যায়, কাহিনি থেকে যায়। এ কাহিনিকে সম্ভব অসম্ভব অবাস্তব কল্পনার আধিক্য আছে। কিন্তু সমাজতত্ত্বগত বিশ্লেষণে ওই সমাজের মানসিক প্রবণতর সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। আর যে জনগোষ্ঠী ও পুরাতন মূল্যবােধে অমর তাদের মধ্যে মিথের সন্ধান ততবেশি মিলবে। 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসে সমাজের অনড়তা এবং মিথের আধিক্য এবং লক্ষণীয়।


এ উপন্যাসের শুরু হয় 'মিথ' দিয়ে। রাতে ঘন জঙ্গলে শিস্ কারদেবতা যক্ষ রক্ষ কার—এনিয়ে কাহাররা সন্ত্রস্ত। শিস কখনাে বেল গাছে, শ্যাওড়া ঝােপে ভৰ্ত্তি ব্ৰত্মদৈত্য তলায়, কখনাে কোপাইয়ের তীরে কুলকাটার জঙ্গলে। কখনাে কাছে কখনাে দূরে। অনেক তদন্ত, বন্দুকের আওয়াজ, টর্চের আলাে কোনাে কিছুই এর রহস্য ভেদ করতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের দারােগা বুঝতে না পেরে তার নদীতীরবর্তী অভিজ্ঞতার প্রভাবে বলেছেন নদীর ভেতর থেকে কোনাে কিছু শব্দ তুলেছে। ক্রমেই মিথ পা ফেলে কাহার পাড়ার ভিতরে। শিসের মধ্যে দেবতার ক্রোধ, সুচাদের ভাষায় যাতে কাহারদের অনিবার্য মরণের ইঙ্গিত। ক্রোধের কারণ খুঁজতে গিয়ে বলির পাঁঠা খুঁতাে দেওয়ার কারণ হিসেবে গন্য করে সরাই ভয়ে মরে। সুচাদ, কাহাররা পিতৃ-পিতামহ সূত্রে জেনেছে, বাবার দয়াতেই হাঁসুলী বাঁকের যা কিছু তিনিই কাহারদের দন্ডমুন্ডের মালিক। এরপর সুচাদ বর্ণনা করেছে-এক বন্যাপ্লাবিত দিনে এক আলােকময় নৌকায় বাবার আগমন, এবং নীলকর সাহেবের বৌ তাকে অগ্রাহা করে নৌকাটিকে ধরতে গিয়ে কি চরম বিপদের মাঝে নিপতিত হয়েছিল তারই আনুপূর্বিক ইতিহাস। কর্তাবাবাকে অবহেলায় প্রতিফল স্বরূপ বন্যার জলে সায়েব মেমের তলিয়ে যাওয়াই এ উপন্যাসের চরমতম মিথ।


বন্যা ও সৃজনের মিথ বহু দেশেই প্রচলিত। 'নােয়া'র সময়ে সর্ব বিধ্বংসী বন্যা, বন্যায় মায়া সভ্যতার সর্প, বিষ্ণুর অনন্ত নাগে হেলান দিয়ে থাকা প্রভৃতি তার কয়েকটি উদাহরণ। আলােচ্য উপন্যাসে গাজনের গল্প প্রসঙ্গে পাখি বলেছে একসময় সৃষ্টি ছিল না, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী মানুষ পশুপক্ষী কিছুই না। শুধু আধারে কালারুদ্রের চড়ক ঘুরছিল। এবং অন্যত্র 'পিথিমী ছিষ্টি' হল, কাহার ছিষ্টি করলেন বিধাতা, কাহারদের মাতব্বরও ছিষ্টি হয়েছে সেই সঙ্গে। এ হলে অন্য সব দেশের আদিম জাতি উপজাতির সৃষ্টি বিষয়ক মিথের সযােত্র।


অপদেবতার মিথও এ উপন্যাসে আছে। বনওয়ারী বারংবার অপদেবতার অস্তিত্ব অনুভব করে। বাবার ক্রুম্ধমূর্তি ভেসে ওঠে চোখে। অজগরের মাথায় খড়ম পায়ে দিয়ে গেরুয়া পরে ন্যাড়ামাথা বাবাঠাকুর ভেসে ওঠে। ন্যাড়ামাথা শিলা বাবার পৈতে হয়ে যায় দুধ গােকরের পৈতে। এই রূপান্তরণ লক্ষণীয়। সাপের সঙ্গে যােগ মিথ হিসাবে সেটাও লক্ষণীয়। আমরা এমন ধরন মিথকে মিথ বলতে পারি।


সুচাঁদ পিসি বান গোঁসাইয়ের মিথ বলেছে, বান গোঁসাই ছিল ছােটো জাতের রাজা, মহেশ্বর ভক্ত, সন্ন্যাস করত, হাড়ের মালা পরত, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তার একশ বৌ, এক মেয়ে, নাম উষা, যাকে দেখে নারায়ণের নাতির মন টলে। একদিন নাতি উষার ঘরে ঢুকে পড়লে বান গোঁসাই তাকে খুন করতে যায়। আসন টলে গেলে নারদের সাহায্যে জানতে পেরে নারায়ণ গোঁসাই বাড়ি হানা দেয়। লড়াইয়ে পৃথিবী টলমল করে ওঠে, জ্বলে আগুন, মাটির বুক ফেটে জল, আকাশের তারা ঘসে যায়, চক্র দিয়ে নারায়ণ বানের হাত কেটে ফেলে। তবু তার জিদ দেখে বাবা কালারুদ্র এসে হরিহর মিল করিয়ে দেন, নাতির বিয়ে হয় উষার সঙ্গে।


ইন্দ্রের মিথ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেবরাজ ইন্দ্র হাতিতে চড়ে মেঘের সাত সমুদ্র ঘুরে বেড়ান। তার বাহন মেঘের সাত সমুদ্র থেকে শুড়ে জল টেনে নিয়ে ছিটিয়ে দেয় চারধারে মাঝে মাঝে দেবরাজ তার হাতের বজ্ৰদণ্ড দিয়ে মেঘের সমুদ্রে আঘাত করেন, তা থেকে ঝলকে ঝলকে ওঠে আগুনের লকলকানি। কখনাে ইন্দ্রের ভাই পবনও তার সঙ্গে বের হয়। মাঝে মাঝে হাতিটা ক্ষেপে পিলখানা থেকে শিকল ছেড়ে বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেঘের সমুদ্রে। লেখক নিজেই জানিয়েছেন—এহল জলস্তম্ভ। মাইতাে ঘােষ মিথ মান্য না করে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বলে ক্ষমা চাওয়া হয়। অর্থাৎ মিথ ব্যাখ্যায় মিথ্যুতির ভয়।


পাথরের মধ্য দিয়েও বিশেষ মিথের সৃষ্টি হয়েছে। পাথরের গায়ে সাদা দাগ, যা পৈতের মতাে। আর এক ধরনের পাথর আছে, যা গাছের গুঁড়ির মতাে দেখতে। সুচাদ বলে অসুরের কাঁড়ি। অর্থাৎ অসুরের হাড় জমে পাথর হয়ে গেছে। দেবতারা অসুর মেরে ছিলেন। তাদের হাড়। বনওয়ারী আবার এ ধরনের মিথে বিশ্বাসী নয়। আর আছে উকুনের মিথ। উকুন হাতে নিয়ে নােখ দিয়ে চেপে মারলে পট করে শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে একজনকে মুখ দিয়ে শব্দ করতে হবে-হুঁ। ওই শব্দটা না করলে উকুনের স্বর্গলাভ হয় না। কখনাে কখনাে প্রবচনে মিথ ব্যবহৃত হয়। যেমন—পরের ধন কালারুদ্রের কণ্ঠের বিষ। দক্ষিণদিক পানে চেয়ে না দেখার নিষেধ। নিশি ডাকার প্রসঙ্গটিও এখানে উল্লেখিত।


তাই বলতে হয়, এ উপন্যাসে যেমন আছে মিথের ব্যাপ্ত উপস্থাপনা তেমনি তা বিচিত্রও বটে, যাতে একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, সংস্কার সংশয় কাজ করে যায়। চতুর্থ পর্ব থেকেই মিথ ও দেবতার কার্যকারিতায় সংশয় আসতে থাকে। অর্থনৈতিক সংঘাতে, অভিলাসিত শাস্তি না দেখে। এই সংশয় মানে ক্রম অগ্রসরমান সাম্প্রতিকতায় মিথ ও বাস্তবের দ্বন্দ্বের যে কথা একাধিক লেখকের লেখাতে বিচিত্রভাবে উদঘাটিত হয়েছে। এককথায় উপন্যাসটির প্রায় সমগ্রতা জুড়ে মিথের অবস্থান লক্ষিত হয়।