প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতে শিল্পের অগ্রগতির কারণ কী ছিল? এই সময় শিল্পের বিকাশে সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছিল?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারতে শিল্পে অগ্রগতির কারণ
[1] পুঁজিপতিদের সুবিধাদান: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেনের কলকারখানাগুলি যুদ্ধ-সংক্রান্ত কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পর্যাপ্ত ভােগ্যপণ্য উৎপাদনে এবং ভারতে পর্যাপ্ত শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করতে ব্রিটেন ব্যর্থ হয়। এই শূন্যতার সুযােগে। ভারতের বাজার দখলের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ও জাপান তৎপরতা শুরু করে। আমেরিকা ও জাপান কর্তৃক ভারতের বাজার দখলের তৎপরতা প্রতিরােধ করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় পুঁজিপতিদের শিল্পস্থাপনে কিছু কিছু সুযােগসুবিধা দিতে শুরু করে।
[2] সংরক্ষণ নীতি: ব্রিটিশ সরকার ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর এদেশে বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতি অর্থাৎ সেসব শিল্পের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিশেষ কিছু সুবিধাদানের নীতি গ্রহণ করে। ফলে বিদেশি শিল্পপণ্যের অসম প্রতিযােগিতার হাত থেকে ভারতীয় শিল্প কিছুটা রক্ষা পায়। এই পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে হলেও ভারতে শিল্পায়নের সুবিধা হয়।
[3] অর্থনৈতিক মহামন্দা: ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বা মহামন্দা দেখা দেয়। এতে ব্রিটিশ শিল্পের অগ্রগতিও যথেষ্ট ব্যাহত হয়। এই সুযােগে ভারতে শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করে।
[4] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের প্রয়ােজনে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ব্রিটেন সহ বিভিন্ন দেশ বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ইউরোপে শিল্পের উৎপাদন ও অগ্রগতি দারুণভাবে ব্যাহত হয়। ইউরােপীয় শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সুযােগে ভারতে শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়।
[5] দেশীয় পুঁজিপতিদের ভূমিকা: শিল্পের বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের বিনিয়ােগ একান্ত অপরিহার্য। ইতিপূর্বে ভারতের শিল্পায়নের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইউরােপীয় মূলধনের বিনিয়ােগ হয়েছিল। কিন্তু বিংশ শতকের প্রথম থেকে এদেশের শিল্পায়নে ভারতীয় পুঁজিপতি ও শিল্পপতিরাও যথেষ্ট পরিমাণে মূলধন বিনিয়ােগ করতে থাকে।
শিল্পের অগ্রগতিতে সরকারি উদ্যোগ
[1] শিল্প কমিশন নিয়ােগ: ভারত সরকার ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস হল্যান্ড-এর নেতৃত্বে একটি শিল্প কমিশন গঠন করে। এই কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে শিল্পের প্রসার ও ব্যাবসাবাণিজ্যে ভারতীয় মূলধন বিনিয়ােগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।
[2] কমিশনের সুপারিশ: সরকার কর্তৃক নিযুক্ত শিল্প কমিশন ভারতে শিল্পের প্রসারের জন্য সরকারকে উৎসাহমূলক হস্তক্ষেপ নীতি গ্রহণের সুপারিশ করে। ভারতে শিল্পের অগ্রগতির প্রয়ােজনে কমিশন সরকারকে যেসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেয়, সেগুলি হল—
[i] যানবাহন ও যােগাযােগ,
[ii] সর্বভারতীয় ও প্রাদেশিক শিল্পবিভাগ প্রতিষ্ঠা,
[iii] কারিগরি শিক্ষার প্রসার,
[iv] বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি চাকরিগুলির সুষ্ঠু সমন্বয় প্রভৃতির উদ্যোগ নিতে হবে।
[3] সরকারি রিপাের্টের ভুমিকা: ব্রিটিশ সরকার ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপাের্ট প্রকাশ করে। এই রিপাের্টে ভারতে শিল্পের বিকাশের সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। যদিও মন্টেগু চেমসফোর্ডের সুপারিশ আইন হিসেবে গৃহীত হয়েছিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।
[4] সংরক্ষণ নীতি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শিল্পগুলিকে বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযােগিতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এদেশের শিল্পপতি ও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। ফলে সরকার ভারতের শিল্পক্ষেত্রে কিছু কিছু সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে। লােহা, ইস্পাত, কাগজ, সুতিবস্ত্র, চিনি, লবণ, দেশলাই প্রভৃতি শিল্পপণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক কিছুটা কমানাে হয়। এর ফলে ভারতে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়।