ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি কীরূপ ছিল?

সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চত্য শিক্ষার প্রসারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান। মধ্যবিত্তদের মধ্যে বাংলার গন্ধবণিক, মাদ্রাজের চেট্টি, গুজরাটের হিন্দু বণিক, কেরলের মােপলা, রাজস্থানের মাড়ােয়ারি প্রভৃতি বণিক সম্প্রদায়গুলি ছিল খুবই ধনী।


মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষা

[1] আধুনিক ভাবধারা গ্রহণ: শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ, গণতান্ত্রিক আদর্শ, মানবতাবাদ প্রভৃতি আধুনিক ভাবধারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে প্রথমদিকে সর্বাধিক অগ্রগণ্য ভূমিকা নেন আধুনিক ভারতের অগ্রদূত রাজা রামমােহন রায়। মধ্যবিত্তদের আধুনিক ভাবধারা ক্রমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়।


[2] চাকরির সন্ধান: শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সর্বাধিক পছন্দের পেশা ছিল সরকারি চাকরি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষিত যুবকের সংখ্যা যথেষ্ট হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই হারে সরকারি চাকরি না বাড়ায় তারা সমস্যার মুখে পড়ে। তবে এই সময় থেকে পাশ্চাত্য ধাঁচের নতুন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত প্রভৃতির সংখ্যা বাড়তে থাকলে শিক্ষিত যুবকরা কিছু চাকরি পেতে থাকে। তবে ভারতীয়রা যােগ্যতা অনুসারে উচ্চশিক্ষা লাভে বঞ্চিত হয়।


[3] ভূমিকেন্দ্রিক পেশা: ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলে বহু মধ্যবিত্ত অকৃষি জমিকে কৃষিজমিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। কৃষিপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে এই মধ্যবিত্তদের কাছে জমিদারি পরিচালনা একটি লাভজনক ব্যাবসায় পরিণত হয়। শহুরে বাঙালি চাকরিজীবী ও অন্যান্য ধনী মধ্যবিত্তদের কেউ কেউ নিলামে জমি কিনে লাভজনক ব্যাবসায় প্রবেশ করতে থাকে।


[4] গণতান্ত্রিক অধিকার: শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতির একনিষ্ঠ সমর্থকে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের স্বেচ্ছায় এসব অধিকার দেবে না—এ কথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ভালােভাবেই অনুভব করে। ব্রিটিশ সরকারের অস্ত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.), দেশীয় সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.), নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন (১৮৭৬ খ্রি.) প্রণয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে মধ্যবিত্তদের সেই ধারণা স্পষ্ট হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকারের শাসননীতির বিরােধিতা করে তারা এসব অধিকার আদায়ে তৎপর হয়।


[5] রাজনৈতিক উচ্চাকাক্ষা: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা প্রথমদিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানালেও কিছুকাল পর তারা ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে সরব হয়। তারা ব্রিটিশ ভারতের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের দাবি জানায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬১ ও ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আইনে ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি খুব বেশি নজর না দেওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্ষুব্ধ হয়।


উপসংহার: ঔপনিবেশিক ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতের জাতীয়তাবােধের অগ্রদূত। তাদের প্রচারের ফলেই ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম তীব্রতর হয়। ব্রিটিশবিরােধী জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রসার এবং সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য নেতৃত্বের প্রয়ােজন ছিল। প্রথমদিকে নেতৃত্বের অভাব থাকলেও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের উত্থানের পর সেই নেতৃত্বের অভাব দূর হয়। তাদের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হয়ে ওঠে।