ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে আদিবাসী শ্রেণির আন্দোলন সংক্ষেপে বিবৃত করাে।

ভারতের আদিবাসী শ্রেণির আন্দোলন


[1] চুয়াড় বিদ্রোহ


  • কারণ


    • জীবিকা সমস্যা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ ভােগদখল করা জমি কেড়ে নিলে চুয়াড়দের স্বাধীন জীবিকার সমস্যা দেখা দেয়।


    • খাজনার হার বৃদ্ধি: আবাদি জমিতে খাজনার হার বাড়িয়ে দেওয়ায় চুয়াড়রা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এদের সঙ্গে বিক্ষুদ্ধ কৃষক, পাইক, প্রমুখরাও যােগ দেয়।


  • প্রসার: ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ব্যাপক হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীরা বহু এলাকায় সরকারি সম্পত্তি ও ফসল পুড়িয়ে দেয়। গােবর্ধন দিকপতি, মােহনলাল, লাল সিং প্রমুখের নেতৃত্বে ৩৮টি গ্রামের সর্দার ও পাইক সম্প্রদায় গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালায়।


  • বিদ্রোহ দমন: ব্রিটিশের তীব্র দমননীতির কাছে বিদ্রোহীরা আত্ম সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।


  • তাৎপর্য: বিদ্রোহের শেষে চুয়াড়দের একাংশকে পুলিশের কাজে নেওয়া হয় এবং পাইকদের নিষ্কর জমি ফেরত দেওয়া হয়। নতুন ব্যবস্থায় বলা হয়, পাইকরা খুব কম হারে রাজস্ব দেবে এবং তাদের জমিকে খাসজমি করে নেওয়া হবে না।


[2] কোল বিদ্রোহ


  • কারণ


    • রাজস্বৃদ্ধি: ইংরেজ কোম্পানি ছােটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার পাওয়ার পর অঞ্চলটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বহিরাগত হিন্দু, মুসলিম, শিখ মহাজনদের ইজারা দেয়। এইসব মহাজন রাজস্বের হার বৃদ্ধি করলে কোলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।


    • জীবিকায় আঘাত: কোম্পানির আমলে চুয়াড়দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আফিম চাষ করানাে হতে থাকে। এতে কোলদের জীবিকাগত ঐতিহ্যে আঘাত লাগে ও তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।


  • নেতৃত্ব: বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিরাই মানকি, সুই মুণ্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে কোল বিদ্রোহ পরিচালিত হয়।


  • বিদ্রোহের বিস্তার ও দমন: ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম সংঘবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। বিদ্রোহী কোলদের সঙ্গে যােগ দেয় সাধারণ চাষি, কামার, কুমাের, গােয়ালা প্রভৃতি নিম্নবর্গীয় ও শােষিত মানুষ। ইংরেজ সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করে।


  • গুরুত্ব: কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার কোল উপজাতিদের জন্য 'দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি ভূ-খণ্ড নির্দিষ্ট করে দেয়। কোলদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট এইসব অঞ্চলে কয়েকটি স্বতন্ত্র নিয়মকানুন চালু হয়।


[3] সাঁওতাল বিদ্রোহ


  • কারণ


    • খাজনা ও উপশুল্ক আরােপ: আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত সাঁওতালদের আবাদি জমিগুলি জমিদাররা হস্তগত করে। পাশাপাশি কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে তাদের থেকে বিভিন্ন খাজনা ও উপশুল্ক আদায় করলে সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘােষণা করে।


    • বন্ড প্রথা: অভাবের তারনায় সাঁওতালরা মহাজনদের থেকে কামিয়াতি ও হারহয়াহি নামে দুই ধরনের বন্ডে সই করে ঋণ নিত। খাদ্যশস্য বা অর্থ হিসেবে নেওয়া এই ঋণ যতদিন না তারা শােধ করতে পারত ততদিন তাদেরকে মহাজনদের জমিতে বেগার খাটতে হত।


    • ব্যবসায়ীদের কারচুপি: সাঁওতাল পরগনাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেচারাম নামক বাটখারা দ্বারা হিসাবে কম ওজনের দ্রব্য বিক্রি করে সাঁওতালদের ঠকাত। আবার সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনাে শস্য কেনার সময় হিসাবের থেকেও ভারী ওজনের কেনারাম বাটখারা ব্যবহার করে।


  • গুরুত্ব বা ফলাফল: একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগনা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে।বলা হয়, সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোনাে আইনবিধি কার্যকর করা হবে। বিদ্রোহের পর সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় ব্রিটিশ সরকার।


[4] মুণ্ডা বিদ্রোহ


  • কারণ


    • কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন: আদিবাসী মুণ্ডাদের কৃষিব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল খুঁৎকাঠি প্রথা অর্থাৎ জমির যৌথ মালিকানার প্রথা। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন তাদের সেই চিরাচরিত প্রথাকে উপেক্ষা করে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে।


    • জমি দখল: উত্তরের সমভূমি থেকে আগত ঠিকাদার, মহাজন ও জমিদাররা মুণ্ডাদের জমিগুলি (ভুঁইহারি জমির থেকে বিতাড়িত করে সেগুলি নিজেদের খাসজমি (মাঝিহাম)-তে পরিণত করে। ফলে মুণ্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।


  • গুরুত্ব বা ফলাফল: মুণ্ডা বিদ্রোহের তীব্রতা হ্রাসের লক্ষ্যে ছােটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন (১৯০৮ খ্র.) পাস হয়। প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে প্রজাদের খুঁৎকাঠি বা মুণ্ডকটি প্রথা অর্থাৎ জমির যৌথ মালিকানার প্রথা স্বীকার করে নেওয়া হয়।


[5] ভিল বিদ্রোহ


  • কারণ


    • খান্দেশ অধিকার: ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা খান্দেশ অধিকার করলে ভিলরা ক্ষুদ্ধ হয়। ঔপনিবেশিক আমলে এই অঞ্চলে প্রবর্তিত সরকারি নিয়মকানুন ও কর্তৃত্ব মানতে না পেরে ভিলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।


    • মাড়ােয়ারি সাউকারদের অত্যাচার: মাড়ােয়ারি সাউকার ও মহাজনদের কাছ থেকে ভিলরা অভাবের তাড়নায় চড়া সুদে টাকা ধার নিত। কিন্তু তারা সেই ঋণ শােদ দিতে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর সাউকাররা নিদারুণ শােষণ ও উৎপীড়ন চালাত।


  • দমন: প্রথমদিকে কর্নেল আউট্রামের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী ভিল বিদ্রোহ দমন করলেও ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল।


  • গুরুত্ব: ভিল বিদ্রোহের ফলস্বরূপ শােষক মাড়ােয়ারি মহাজন শ্রেণি রাজস্থানের গ্রামাঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়।