ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিচয় দাও।

সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সর্বাধিক শােষিত ও নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়। সাঁওতাল, কোল, ভীল, মুন্ডা, ওরাঁও, হাে, ভূমিজ, খন্দ, গােণ্ড, ভারলি, নাগারা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায় প্রকৃতির কোলে বসবাস করত এবং প্রকৃতির সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের তীব্র শােষণের শিকার হয়ে তারা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।


আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবস্থা

[1] করারােপ: আদিবাসীরা ব্রিটিশ আমলে তথাকথিত সভ্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে শুরু করলে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার উনিশ শতকে আদিবাসী সম্প্রদায় সরকারের আইন, শাসন ও বিচার-ব্যবস্থার আওতায় আনে। ভূমি বন্দোবস্ত করে সরকার আদিবাসীদের জমির ওপর কর আরােপ করে ও আদিবাসী কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ে তীব্র নির্যাতন চালায়।

'দিকু'দের ভূমিকা: সরকার ও আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে বহিরাগত জমিদার জোতদার, বণিক, মহাজন, ঠিকাদার, দালাল প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভােগীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে আদিবাসী এলাকায় ঢুকে পড়ে। আদিবাসীরা এই মধ্যস্বত্বভােগী বহিরাগতদের 'দিকু' বলত। 'দিকু'-রা আদিবাসীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা ও শােষণ চালায়।


[2] অরণ্যের অধিকার ব্যাহত: আদিবাসীরা পাহাড় ও মালভূমির অরণ্যাঞলে ঝুম চাষ করে খাদ্য উৎপাদন করত এবং অরণ্য থেকে বিভিন্ন সম্পদ আহরণ করত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত অরণ্যাঞ্লে ঝুম চাষ নিষিদ্ধ করে এবং অরণ্য-সম্পদের ওপর সরকার একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।


[3] সামাজিক আগ্রাসন: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন সামাজিক আগ্রাসনের শিকার হয়। খ্রিস্টান মিশনারিরা আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি তাদের খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। নতুন পাশ্চাত্য খ্রিস্টান সংস্কৃতির প্রভাবে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাদী সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়।


[4] শােষণ ও বঞ্চনা: উনিশ শতকে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা চা-কফির বাগিচা চাষ শুরু করে। অসংখ্য আদিবাসী শ্রমিককে সেখানে নিয়ে তাদের চা-কফি চাষে নিয়ােগ করা হয়। সেখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং সীমাহীন অত্যাচারের শিকার হয়ে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সারা দেশে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হলে প্রচুর আদিবাসী শ্রমিককে এই কাজে নিয়ােগ করা হয়। কয়লা উৎপাদনের কাজেও প্রচুর সংখ্যক আদিবাসী শ্রমিক নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে দিনের পর দিন নানাভাবে তাদের বঞ্চিত করা হয়।


[5] মুক্তির উদ্যোগ: আদিবাসী সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য শােষকদের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রয়াস চালায়। তারা নিজেদের সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করে। সরকারি রাজস্ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। শােষণ থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা ছােটোনাগপুর অঞ্চলের কোল উপজাতি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এবং বিহারের সাঁওতাল উপজাতি ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার আশায় গুজরাটের এক আদিবাসী সম্প্রদায় ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ চৌকি আক্রমণ করে। দক্ষিণের রম্পা অঞ্চলে বনের কাঠ সংগ্রহ ও চারণভূমির ওপর অধিকারের দাবিতে বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহের নেপথ্যেও একই ধরনের পটভূমি কাজ করেছিল।


উপসংহার: ঔপনিবেশিক আমলে আদিবাসী সম্প্রদায় সর্বাধিক সামাজিক অসাম্যের শিকার হয়। ব্রিটিশবিরােধী মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) বা জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে ভারতের শােষিত ও নিপীড়িত আদিবাসী সম্প্রদায়ই প্রথম ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের ভিত তৈরি করে। তাদের বিদ্রোহ ব্রিটিশবিরােধী কৃষক বিদ্রোহগুলিকেও শক্তি সরবরাহ করে।