ঔপনিবেশিক শাসনকালে গ্রামীণ কৃষকদের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে আলােচনা করাে।

সূচনা: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। এক শ্রেণির কৃষক বিপুল পরিমাণ জমিজমা ও অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। তারা পতিত জমি উদ্ধার, অর্থকরী ফসল উৎপাদন, কৃষি-খামার প্রতিষ্ঠা, সুদের ব্যাবসা প্রভৃতির মাধ্যমে এই সম্পদের মালিক হয়। মহাজনি কারবার ও ধনী কৃষকদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।


ঔপনিবেশিক আমলে গ্রামীণ কৃষক সমাজে শ্রেণিবিভাজন

[1] ধনী কৃষক: ব্রিটিশ শাসনকালে একশ্রেণির গ্রামীণ কৃষক বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। ধনী কৃষকরা তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ মহাজনি কারবারে নিয়ােজিত করে দরিদ্র কৃষকদের উচ্চ সুদে ঋণ দেয়। গ্রামীণ মহাজনদের সংখ্যা কম হলেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে তারা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী শ্রেণি হিসেবে উঠে আসে। এই ধনী কৃষক ও মহাজন শ্রেণির সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। গ্রামীণ কৃষকদের ঋণের অন্তত ৭৫ শতাংশই মহাজনদের কাছ থেকে আসত বলে ব্যাংকিং এনকোয়ারি কমিটির রিপাের্ট (১৯২৯-৩১ খ্রি.) থেকে জানা যায়। এই সময় বাংলায় অন্তত ৩০ শতাংশ ধনী কৃষক এই কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।


[2] ভাগচাষি: গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল ভাগচাষি বা বর্গাদার শ্রেণি।


  • ভাগচাষির আবির্ভাব: ধনী কৃষকরা সরাসরি তাদের জমি চাষের কাজে যুক্ত ছিল না। তাদের কৃষিজমি চাষের দায়িত্ব দেওয়া হত ভাগচাষিদের হাতে। বহু দরিদ্র কৃষক মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশােধে ব্যর্থ হলে মহাজন তাদের জমিজমা দখল করে নিত। এভাবে জমি হারিয়ে তারা ভাগচাষিতে পরিণত হত।


  • ফসল প্রাপ্তি: ভাগচাষিরা নিজেদের খরচে মালিকের জমি চাষ করত এবং এর বিনিময়ে তারা উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ পেত। তারা ফসলের মাধ্যমে তাদের খাজনা পরিশােধ করত।


[3] ভূমিহীন কৃষক-মজুর


  • অবস্থান: ব্রিটিশ শাসনকালে গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের তৃতীয় স্তরে অবস্থান করত ভূমিহীন কৃষক শ্রেণি। তারা ধনী কৃষকের জমিতে শ্রমদানের বিনিময়ে নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের নিম্নস্তরের দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ ভূমিহীন খেতমজুরে পরিণত হয়েছিল। মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশােধে ব্যর্থ হয়ে বহু কৃষক ভূমিহীন ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়।


  • পরিসংখ্যান: হান্টারের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ পরগনা জেলায় খেতমজুরের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীকালেও এই বৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি রিপাের্ট থেকে জানা যায় যে, এই সময় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অন্তত ১৭.৫ শতাংশ কৃষকই ছিল ভূমিহীন খেতমজুর।


উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনাধীন গ্রামীণ সমাজে ধনী কৃষক সম্প্রদায় ও মােড়লরা ব্রিটিশ সরকারের সমর্থক শ্রেণিতে পরিণত হয়। অন্যদিকে তাদের নীচের স্তরে অবস্থানকারী ভাগচাষি ও ভূমিহীন কৃষক-মজুররা সুদখাের মহাজন ও সরকারের শােষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়। প্রতিবাদী এই কৃষক শ্রেণির বিভিন্ন বিদ্রোহই ছিল ভারতে ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক শােষণের বিরুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ।