ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিচয় দাও।

সূচনা: খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে বৈদিক সভ্যতার যুগ থেকেই ভারতে শূদ্র নামে অস্পৃশ্য দলিত জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে আরও বহু অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য জাতির উদ্ভব ঘটে। এই অনগ্রসর, শােষিত ও নির্যাতিত সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনকালে দলিত নামে পরিচিত হয়। এই সময় তারা উচ্চবর্ণের নানা শােষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়। তাই দলিতদের কাছে ইংরেজ বিরােধিতার চেয়ে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।


দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থা

[1] অবহেলার শিকার: শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা গ্রামগঞ্জের দলিত শ্রেণির মানুষ সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষা জানত না বলে তারা নিজেদের কথ্যভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করত। উচ্চবর্ণের মানুষ দলিতদের এই কথ্যভাষাকে খুবই অবজ্ঞা করত। ব্রাক্ষ্মণরা দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষাকে যথেষ্ট ঘৃণার চোখে দেখত।


[2] কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি: জাতীয় কংগ্রেসে উচ্চবর্ণের নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তারা অনেকেই জাতিভেদপ্রথার সমর্থক ছিল। কংগ্রেস নেতাদের এরূপ মনােভাবের ফলে দলিতদের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং তারা ক্রমে কংগ্রেসের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি চেষ্টার সক্রিয় চেষ্টা চালায়। অবশ্য মহাত্মা গান্ধি হরিজন আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেসের প্রতি দলিতদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গান্ধিজির সাবধানী উদ্যোগ দলিতদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।


[3] বাংলায় দলিত সক্রিয়তা: উনবিংশ শতকে বাংলার দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ব্রায়ণ্য আধিপত্য ও শােষণের বিরুদ্ধে সরব হয়। প্রথমদিকে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রমুখ দলিত নেতা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শােষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও কোচদের তপশিলি জাতিভুক্ত করলে এর বিরুদ্ধে তারা সামাজিক আন্দোলন শুরু করে।


[4] দলিত সংগঠন: দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অব্রাহ্মণদের মধ্যে যােগাযােগ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জাস্টিস পার্টি (১৯১৭ খ্রি.) নামে দলিতদের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে অনুষ্ঠিত দলিত নেতাদের সম্মেলনে দলিত আন্দোলনের গতি আসে। এখানে সর্বভারতীয় নিপীড়িত সমিতি গঠিত হয়। এস. সি. রাজা এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ড. আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দাবি করেন।


[5] আম্বেদকরের ভূমিকা: গান্ধিজি-সহ অন্যান্য কিছু নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অস্পৃশ্যতা-বিরােধী দলিত নেতা আম্বেদকরের কাছে বিশেষ মূল্যবান ছিল না। দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ বা উচ্চবর্ণের সঙ্গে মেলামেশার অধিকারের চেয়ে তিনি দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটানাের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দলিতদের নিয়ে মহারাষ্ট্রে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন এবং প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি গ্রন্থটি পুড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরােধিতা করেন। তিনি দলিতদের শিক্ষা, সংগঠন ও বিক্ষোভ আন্দোলনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।


[6] পুনা চুক্তি: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড তাঁর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ (১৯৩২ খ্রি.) নীতির মাধ্যমে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দিলে গান্ধিজি এর তীব্র প্রতিবাদ করে অনশন শুরু করেন। (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২খ্রি.)। শেষপর্যন্ত পুনা চুক্তির (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রি.) মাধ্যমে আম্বেদকর দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকারের দাবি থেকে সরে আসেন এবং গান্ধিজিও দলিতদের আরও বেশি সংখ্যক আসন সংরক্ষণের দাবি মেনে নেন।


উপসংহার: আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় তপশিলি জাতি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে দলিত আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেসও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্-মুহূর্তে দলিত নেতা আম্বেদকরকে সংবিধানের খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। একজন দলিত নেতার নেতৃত্বাধীন কমিটি স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার অধিকার পায়। তাঁর নেতৃত্বে রচিত নতুন সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি বলে ঘােষণা করা হয়।