ব্রিটিশের উপনিবেশ বিস্তারের কাহিনি সম্পর্কে লেখাে।

সূচনা: বিশ্বের উপনিবেশ গঠনকারী দেশগুলির মধ্যে সবার থেকে এগিয়ে ছিল ব্রিটিশরা। তাই ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল উপনিবেশ বিস্তারের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের একাধিপত্যের যুগ নামে চিহ্নিত।


ব্রিটিশের উপনিবেশ বিস্তার

[1] অস্ট্রেলিয়া: সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজ নাবিক ও আবিষ্কারকদের প্রচেষ্টায় অস্ট্রেলিয়ায় জলপথে অনুপ্রবেশের ধারণা তৈরি হয়। যদিও সেসময়ে অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ গড়ে তােলার ব্যাপারে তেমনভাবে কেউ সাফল্য পায়নি। অষ্টাদশ শতকের শেষপাদে ব্রিটিশ নাবিক ও আবিষ্কারক ক্যাপটেন কুক অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলের সন্ধান পান। তিনি এখানকার বােটানি হ্রদ (Botany Bay)-এ সর্বপ্রথম ব্রিটিশ পতাকা ওড়ান। শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে বাসােপযােগী করে তুলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়।


[2] নিউজিল্যান্ড: অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ নাবিক ও আবিষ্কারক ক্যাপটেন কুক অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে ওয়েক ফিল্ড-এর নেতৃত্বে বহু ইংরেজ এখানে এসে বসবাস শুরু করে। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।


[3] কানাডা: কানাডার সর্ববৃহৎ অঞ্চল কুইবেকের বেশিরভাগ অধিবাসী ছিল ফরাসি। ফরাসিদের দুর্বলতার সুযােগে এখানে ব্রিটিশদের অনুপ্রবেশ ঘটে। বড়ােলাট নর্থ কর্তৃক 'কুইবেক অ্যাক্ট' (১৭৭৪ খ্রি.) নামক আইন পাসের মাধ্যমে কুইবেকবাসীকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা ছাড়াও বেশ কিছু সুযােগসুবিধা দেওয়া হয়। তবুও কানাডায় বসবাসকারী ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে বিরােধ লেগে থাকত। এর সুযােগ নিয়ে আমেরিকা সেখানে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, এই ভয়ে ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় কানাডা অ্যাক্ট পাস করান। কিন্তু শেষপর্যন্ত কানাডার স্থায়ী বাসিন্দারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করে (১৮৬৭ খ্রি.)।


[4] ত্রয়ােদশ উপনিবেশ: ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নীতির ফলে সপ্তদশ শতক থেকে ইংল্যান্ডের প্রচুর মানুষ। আমেরিকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে এসে বসবাস শুরু করে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যে ব্রিটিশরা বেশ কয়েকটি যুদ্ধে আমেরিকাস্থিত ওলন্দাজ ও ফরাসি শক্তিকে পরাজিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলে তেরােটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে।


[5] ভারত: বিশ্বে ব্রিটিশের সমস্ত উপনিবেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশটি ছিল ইংরেজ জাতির কাছে সর্বাধিক মূল্যবান এবং লাভজনক এক উপনিবেশ। প্রায় ২०० বছর ধরে ব্রিটিশরা ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ চালায়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী ১০০ বছর ধরে এদেশে কোম্পানির কর্তৃত্ব বজায় থাকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর বণিক। কোম্পানির হাতে ভারতের শাসনভার রাখা নিরাপদ নয় বিবেচনা করে ভারতের শাসনভার ইংল্যান্ডের রানি ও পার্লামেন্টের হাতে অর্পণ করা হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই আলাদা রাষ্ট্রে ভাগ করে স্বাধীনতা দেওয়া হয়।


[6] দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিংহলে ওলন্দাজ বণিকশক্তিকে সরিয়ে সেখানে ব্রিটিশ নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ও ব্ৰহ্লাদেশকেও নিজের অধিকারে আনে। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালাক্কা এবং ফিজি দ্বীপপুঞ্জ দখল করে ব্রিটিশ তার উপনিবেশের বিস্তার ঘটায়।


[7] দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকায় 'কেপ অব গুড হােপ'-এ ইংরেজরা প্রথম উপনিবেশ গড়ে তােলে। পরবর্তীকালে ওলন্দাজদের কাছ থেকে কেপ কলােনি কেড়ে নিয়ে তারা উত্তর দিকের নাটাল, অরেঞ্জ এবং ট্রান্সভাল অঞ্চলগুলির দখল নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার এই অঞ্চলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশরা ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকা গঠন করে (১৯১০ খ্রি.)। পরবর্তী সময়ে উত্তর মিশর, সুদান, উগান্ডা, বেচুয়ানাল্যান্ড, রােডেশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলের ওপর ইংল্যান্ড নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব আফ্রিকা ছাড়াও জাম্বিয়া, সিয়েরা লিয়ন, গােল্ড কোস্ট, নাইজিরিয়া ও সােমালিল্যান্ডের একাংশও ইংল্যান্ডের অধিকারে আসে।


উপসংহার: ছােট্ট একটি দেশ ব্রিটেন যেভাবে বিশ্বের প্রায় সমস্ত অঞ্চলেই পৌছে গিয়ে নিজের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাতে অন্যান্য ঔপনিবেশিক দেশগুলিও অনুপ্রাণিত হয়েছিল।