উপনিবেশ স্থাপনের কারণ ও নয়া উপনিবেশবাদের কয়েকটি কুফল লেখাে।

উপনিবেশ স্থাপনের কারণসমূহ

[1] বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার আকাক্ষা: গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশগুলিকে নিজের অধীনে এনে বৃহৎ শক্তি হিসেবে মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ইউরােপীয় দেশগুলি পারস্পরিক প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়। এই প্রতিযােগিতায় ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি হয়ে ওঠার আড়ালে তাদের সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এশিয়ার মধ্যে ভারতের অফুরন্ত সম্পদের লােভে প্রলুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশরা এখানে উপনিবেশ গড়ে তােলে। এভাবেই বিভিন্ন ইউরােপীয় দেশগুলি উপনিবেশ গঠনের মধ্যে দিয়ে বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করে।


[2] উদ্বৃত্ত মূলধন: শিল্পোন্নত দেশগুলিতে মূলধনি শ্রেণি নতুন নতুন শিল্পে মূলধন লগ্নির দ্বারা মুনাফার পাহাড় জমিয়ে উদ্বৃত্ত মূলধনের সৃষ্টি করে। এই উদ্বৃত্ত মূলধন দেশের বাইরের কোনাে শিল্পে লগ্নি করে আরও মুনাফা অর্জনের জন্য মূলধনি শ্রেণি সচেষ্ট হয়ে ওঠে। মূলধনের স্ফীতি পরােক্ষভাবে উপনিবেশবাদ উত্থানের প্রেক্ষাপট রচনা করে। এক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লব ও ধনতন্ত্রবাদ উপনিবেশবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।


[3] পুঁজিবাদের প্রসার: ইংল্যান্ড সহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর পুঁজিবাদী অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ে। দেশের মধ্যেকার নানা শিল্পক্ষেত্র ছাড়াও বিদেশের লাভজনক ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়ােগ প্রচেষ্টা দেখা দেয়। পুঁজিবাদের এই সুষ্ঠু প্রসারের জন্য উপনিবেশ গঠনের প্রয়ােজনীয়তা বাড়ে, আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির শেষ কথা হল অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জন। এই অধিকতর মুনাফা অর্জনের তাড়নায় দেশের সীমারেখা ছাড়িয়েও বিদেশের মাটিতে পুঁজিবাদের প্রসার ঘটে। তাই উপনিবেশ গঠনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়।


[4] সামরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা: সামরিক শক্তি বাড়ানাের প্রচেষ্টা থেকেও উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। সামরিক সুযােগসুবিধার কথা বিবেচনা করেই জিব্রাল্টার প্রণালী, সুয়েজ খাল সন্নিহিত অঞ্চল এবং সিঙ্গাপুরে উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে। সেরকমই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। সামরিক কারণেই ব্রিটেন সাইপ্রাসে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। আসলে এই অঞ্চল থেকে সহজেই মধ্যপ্রাচ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব ছিল।


[5] কাঁচামালের আমদানি এবং উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি: শিল্পবিপ্লবের কল্যাণে ইউরােপীয় দেশগুলিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্পপণ্য উৎপাদনের জন্য অফুরন্ত কাঁচামাল জোগানের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য সুবৃহৎ বা আন্তর্জাতিক বাজারেরও দরকার পড়ে। এই উভয় চাহিদা মেটানাের জন্য ইউরােপীয় দেশগুলি উপযুক্ত উপনিবেশের সন্ধান শুরু করে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপিত হয়।


নয়া উপনিবেশবাদের কুফলসমূহ


[1] শােষণ: নয়া উপনিবেশবাদ বৈদেশিক ঋণ, সামরিক অস্ত্র, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে শােষণ করে চলেছে।


[2] অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ: উন্নত দেশগুলি অনুন্নত দেশগুলিকে ঋণ দেওয়ার সময় নানা রকম শর্তের দ্বারা ঋণবহনকারী দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি সেখানকার বাণিজ্য শুল্ক হারও ঋণদানকারী দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শুধু তাই নয় ঋণগ্রহণকারী দেশের বিদেশনীতি প্রণয়ন ও রূপায়ণেও ঋণদানকারী দেশগুলি প্রভাব খাটায়।


[3] সরকার নিয়ন্ত্রণ: নব্য উপনিবেশবাদী শক্তি ঋণগ্রহণকারী দেশের সরকারকেও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তৎপর হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাদী শক্তি বিরুদ্ধ আচরণকারী সরকারকে উৎখাত করে তার বদলে কার্যত পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে। নিজেদের স্বার্থমতাে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই পুতুল সরকারকে পরিচালনা করে। প্রকৃত অর্থে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সাহায্য প্রদানের অছিলায় এই সমস্ত দেশে নয়া উপনিবেশবাদ কায়েম হয়।