দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে জাপানিদের সংযােগজনিত ধারা বিশ্লেষণ করাে।

সূচনা: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আই. এন. এ. (Indian National Army) জাপানি সাহায্যে ভারতের মুক্তি অর্জনে সচেষ্ট হলে উভয়ের মধ্যে সংযােগ স্থাপিত হয়।


আই. এন. এ. ও জাপানিদের সংযােগজনিত ধারা


[1] প্রাথমিক ধারা জাপানিদের দিক থেকে


  • এশিয়ায় জাপানি বিস্তার নীতি: 'বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যৌথ অগ্রগতি বলয়’ পরিকল্পনা অনুসারে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের সম্প্রসারণ ঘটাতে শুরু করে। জাপানের সামরিক সাফল্যে উৎসাহী হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়রা জাপানের সঙ্গে সংযােগ স্থাপনে সচেষ্ট হয়।


  • ফুজিওয়ারার উদ্যোগ: জাপানি ইম্পিরিয়াল জেনারেল হেডকোয়াটার্স-এর মেজর ইওয়াইচি ফুজিওয়ারার নেতৃত্বে ব্যাংককে ফুজিওয়ার কিকন মিশন গঠিত হয়। এই মিশন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যােগসূত্র গড়ে তােলায় সচেষ্ট হয়। ফুজিওয়ারা যুদ্ধবন্দি ভারতীয়দের নিয়ে মােহন সিং এর নেতৃত্বে এক সেনাদল গঠনের উদ্যোগ নেন।


  • ফারার পার্ক-এর সমাবেশ: ক্যাপটেন মােহন সিং-এর নেতৃত্বে জাপানের হাতে বন্দি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে সিঙ্গাপুরের পতনের পরের দিন অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের ফারার পার্ক-এ এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ফুজিওয়ারা ফারার পার্কের এক সমাবেশে যুদ্ধবন্দি ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে বলেন, "আমরা তােমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেব এবং তােমাদের কাজে সর্বতােভাবে সহায়তা করব।"


  • তােজো-র বিবৃতি: সিঙ্গাপুরের পতনের পর জাপানি প্রধানমন্ত্রী তােজো পার্লামেন্ট (Diet)-এ এক বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে তিনি বলেন-জাপান কখনও ভারতীয়দের শত্রু বলে ভাবে না ও ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি অর্জনের লড়াইয়ে জাপান সর্বতােভাবে ভারতবাসীকে সাহায্য করবে।


[2] প্রাথমিক ধারা ভারতীয়দের দিক থেকে


  • আই. এন. এ. গঠন: টোকিওতে আয়ােজিত এক সম্মেলনে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ) ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ (Indian Independence League) গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থির হয় এই সংঘ বা লিগ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জাপানের সহযােগিতা লাভের চেষ্টা চালাবে। পরে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে আয়ােজিত এক সমাবেশে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনী বা আই. এন. এ.।


  • কর্মপরিষদ গঠন: আই. এন. এ.র কার্যপ্রণালী নির্ধারণের জন্য একটি কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের সদস্য হন- রাসবিহারী বসু, জেনারেল মােহন সিং, পি.কে. মেনন এবং জি. কিউ. গিয়ানি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ ও আই. এন. এ. উভয়ের নেতৃত্বদানের জন্য সুভাষচন্দ্রকে আহ্বান জানানাে হয়। সুভাষচন্দ্র যাতে নির্বিঘ্নে পূর্ব এশিয়ায় আসতে পারেন সে বিষয়ে জাপান সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করে এই পরিষদ।


[3] পরবর্তী ধারা


  • সুভাষ-তােজো সাক্ষাৎ: এক দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযান শেষে নেতাজি টোকিও (জাপানের রাজধানী) শহরে আসেন। টোকিওতে এসে সুভাষচন্দ্র জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তােজো (Hideki Tojo)-র সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতের কয়েকদিন পর ইম্পিরিয়াল ডায়েট-এর এক সভায় সুভাষের উপস্থিতিতে তােজো ঘােষণা করেন- "ভারতের স্বাধীনতার জন্য যা যা করা সম্ভব সেসব করতে জাপান প্রস্তুত।"


  • সুভাষের নেতৃত্ব গ্রহণ: তােজোর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে সুভাষচন্দ্র রাসবিহারী বসু ও আবিদ হাসানের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে এসে পৌঁছােন। সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটারে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র।


  • আজাদ হিন্দ ও জাপানি সেনাদের অভিযান: দিল্লি অভিযানের সূচনাকালে সুভাষ ও জাপানি সেনাধ্যক্ষ কাওয়ার কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন, যেমনㅡ

    • আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানি সেনাবাহিনীর সমান মর্যাদা পাবে,

    • আজাদ হিন্দ ও জাপানি উভয় সেনাবাহিনী একই নেতৃত্বাধীনে থাকবে এবং একই সমরকৌশল মেনে যুদ্ধ করবে,

    • অধিকৃত ভারতীয় অঞ্চলগুলির দায়িত্বভার ও কর্তৃত্ব থাকবে আজাদ হিন্দ সেনাদের হাতে।

জাপানিদের সাহায্য ও নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উদ্দীপ্ত হয়ে আজাদ হিন্দ সেনারা আরাকান দখল করে। বার্মা সীমা অতিক্রম করে তারা ভারতভূমিতে পা রাখে এবং মণিপুরের মৈরাং-এ তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল)।


উপসংহার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপানের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ায় আই. এন. এ.র সেনারাও শেষপর্যন্ত অস্ত্র ত্যাগে বাধ্য হন।


এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া নীতি বলতে কী বােঝ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কেন এই নীতি গ্রহণ করে?


'এশীয়দের জন্য এশিয়া'—এই উক্তির আড়ালে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের পরিচয় দাও।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানিদের অগ্রগতি পর্যালােচনা করাে।