মার্কেন্টাইলবাদ এর বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব আলােচনা করাে।

মার্কেন্টাইলবাদের বৈশিষ্ট্য

মার্কেন্টাইলবাদ হল শিল্পবিপ্লবের পূর্বেকার এক অর্থনৈতিক ধারণা। এই ধারণার কেন্দ্রে রয়েছে বণিক গােষ্ঠী যারা অর্থনীতিকে নিয়ােগ করত। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ে সােনা ও রুপাে ছিল আকস্মিত সম্পদ ও অর্থনৈতিক মূল উৎস। পাশাপাশি এই সংরক্ষণবাদী মতবাদে বাণিজ্যিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রপ্তানি বাড়িয়ে আমদানি কমানাের কথা বলা হয়। এই আর্থিক মতবাদের মূল কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল一


[1] সােনা ও রুপাের সঞ্চয় বাড়ানাে: মার্কেন্টাইল মতবাদে সােনা ও রুপােকে মূল্যবান ধাতু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বলা হয়, নিজের দেশকে স্বনির্ভর ও সম্পদশালী করে তােলার জন্য সােনা ও রুপাের সঞ্চয় বাড়াতে হবে। প্রথম দিকে দস্যুবৃত্তি, চোরাকারবাড়ি এবং অন্য দেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে জোগাড় করে সােনা ও রুপাের সঞ্জয় বাড়ানাের ওপর জোর দেওয়া হয়। নৌশক্তিতে শক্তিশালী ইংল্যান্ড, স্পেন, পাের্তুগাল, ফ্রান্স প্রভৃতি ইউরােপীয় দেশ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে সােনা ও রুপা নিয়ে এসে নিজ নিজ দেশে এই দুই মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ায়।


[2] শুল্ক নিয়ন্ত্রণ: মার্কেন্টাইল মতবাদে আমদানি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আমদানির পরিমাণ কমানাের নীতি গৃহীত হয়। এই নীতি কার্যকর করার জন্য আমদানি করা পণ্যদ্রব্যের ওপর অধিক হারে শুল্ক চাপানাে হয়। আমদানি করা কাঁচামালের ওপর শুল্কের হার কমিয়ে দেওয়া হয়।


[3] বুলিয়ানিজম: সােনা বা রুপাের তাল বুলিয়ান নামে পরিচিত। মার্কেন্টাইলবাদের প্রথম পর্যায়ে সােনা ও রুপােই ছিল অর্থনীতির মূল উৎস। তাই, এই পর্যায়ে সােনা ও রুপাের মতাে মূল্যবান দুই ধাতুকে বুলিয়ানিজম বলা হয়। স্পেন ও পাের্তুগালের মতাে দেশগুলি লাতিন আমেরিকা থেকে এই দুই মূল্যবান ধাতু জোগাড় করে এগুলির সঞ্চয় বাড়ায়।


[4] প্রােটেকসনিজম: মার্কেন্টাইলবাদের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু হয় যেখানে রপ্তানিই ছিল মূল লক্ষ্য। নিজ নিজ দেশ তাদের রপ্তানি করা পণ্যসামগ্রী সুরক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য ছিল রপ্তানি বাড়িয়ে এবং আমদানি কমিয়ে দেশের বাণিজ্যিক ভারসাম্য বজায় রাখা। পাশাপাশি দেশের ভিতরে বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী আদানপ্রদানের সুষ্ঠ ব্যবস্থা নেয় রাষ্ট্র।


[5] কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ: মার্কেন্টাইলবাদে কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ ঘটানাে হয়। খাদ্যশস্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দিয়ে দেশের ভিতরে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানাের ওপর জোর দেওয়া হয়। কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহদানের জন্য কৃষিকর মুকুবের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি বণিজ্যিক কৃষিজপণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়।


মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাব বা ফলাফল


[1] অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ: এই প্রথম রাষ্ট্রের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রাধীন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং বণিক ও উৎপাদকদের স্বার্থ অভিন্ন বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ গিল্ডের স্থানে জাতীয় সরকারের হাতে চলে যায়। এইভাবে মার্কেন্টাইলবাদ অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ’-এর রূপ নেয়।


[2] সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসার: মার্কেন্টাইল মতবাদ অনুসারে, মুদ্রা তৈরি, সােনা ও নৌবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির জন্য এবং জাতীয় মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য বুলিয়ন অর্থাৎ সােনা ও রুপাের সঞ্চয় বাড়ানাে অত্যাবশ্যক। এই উদ্দেশ্যে ষােড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বহু ইউরােপীয় রাষ্ট্র সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসার এবং উপনিবেশ স্থাপনে উদ্যেগী হয়।


[3] উপনিবেশ স্থাপন: মার্কেন্টাইলনীতি অনুসারে, ইউরােপীয় দেশগুলি কাঁচামাল সংগ্রহ ও পণ্য বিক্রির বাজার দখলের উদ্দেশ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে, উপনিবেশগুলিতে একাধিপত্য বজায় রাখতে নৌসেনা, শক্তিশালী নৌবহর গঠন, অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধি ইউরােপীয় দেশগুলির মধ্যে সংঘাত তীব্র করে।


[4] কৃষিনীতি: মার্কেন্টাইল মতবাদের কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানাের ওপর জোর দেওয়ার ফলে কৃষকরা একদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যশস্যের অবাধ বিক্রয় এবং বাইরে রপ্তানি নিষিদ্ধ হওয়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ন্যায্য দাম পেত না। এজন্য সে যুগে ইউরােপের কৃষকরা মূলত নিজ পরিবারের প্রয়ােজন মেটানাে এবং সরকারি খাজনা পরিশােধ করার উদ্দেশ্যে উৎপাদন করত। কৃষির উন্নতি ঘটিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কোনাে উদ্যোগ দেখা যেত না।


'মার্কেন্টাইলবাদ' / 'মার্কেন্টাইল' মূলধন বলতে কী বােঝ? এই মতবাদের মূল বক্তব্য তুলে ধরাে।


মার্কেন্টাইল মূলধন অর্থনীতির অবসান কীভাবে ঘটেছিল?


শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন বলতে কী বােঝায়? উপনিবেশের প্রসারে এই মূলধনের ভূমিকা কী ছিল?