শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন বলতে কী বােঝায় | উপনিবেশের প্রসারে এই মূলধনের ভূমিকা কী ছিল?

শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পাের্তুগাল প্রভৃতি ইউরােপীয় দেশগুলি ভৌগােলিক অভিযানের সূত্র ধরে একের পর এক উপনিবেশ গড়ে তােলে। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে মুনাফা বাবদ এইসব দেশের বণিক গােষ্ঠীগুলির হাতে যে মূলধন বা পুঁজি সঞ্চিত হয়, তার নাম বাণিজ্যপুজি (Mercantile Capital)। এই বাণিজ্যপুঁজি পরবর্তী সময়ে দুটি আলাদা পুজিতে রূপান্তরিত হয়, যথা— [1] শিল্প পুঁজি ও [2] মহাজনী মূলধন বা পুঁজিবাদী মূলধন।


[1] শিল্প পুঁজি: ইংল্যান্ড-সহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর শিল্পপুঁজির উদ্ভব ঘটে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর শিল্প পণ্য উৎপাদন করতে শুরু করে। এই উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যগুলি নিজ নিজ উপনিবেশ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রয় করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। অতিরিক্ত মুনাফাকে ইউরােপের শিল্পপতিগণ পুনরায় লাভজনক শিল্পে বিনিয়ােগের মধ্যে দিয়ে মুনাফার পরিমাণকে আরও বাড়ায় এইভাবে অতিরিক্ত মুনাফাকে কেন্দ্র করে যে মূলধন বা পুঁজি সঞ্চিত হয়, তার নাম শিল্প পুঁজি। এই পুঁজির সঞ্চয় ও বিনিয়ােগের মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে পুঁজিবাদী গােষ্ঠীর হাতে।


[2] মহাজনী মূলধন বা পুঁজিবাদী মূলধন: শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময়কালে উৎপাদিত শিল্পপণ্য বিক্রয়ের বাজার দখলকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে প্রতিযােগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযােগিতা বা দ্বন্দ্বের মূল বিষয় ছিল কোন দেশ কত বেশি পণ্যবিক্রয়জাত মুনাফা সঞ্চয় করবে। বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে এই ব্যবস্থায় আর্থিক বিনিয়োেগ শেয়ার ও বন্ড ক্রয়বিক্রয়ের মধ্য দিয়েও মুনাফার হার বাড়ানাের চেষ্টা শুরু হয়। এই পুঁজি ব্যবস্থায় ডিপােজিট ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলি সুদের বিনিময়ে পুঁজি বাড়ানাের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ডিপােজিট ব্যাংকগুলি আমানতকারীদের আমানত গােচ্ছিত রেখে সুদের বিনিময়ে ঋণ দেয়। অপরদিকে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলি নানা ব্যাংকের মারফত পুঁজি জোগাড় করে সেগুলিকে পুনরায় লাভজনক ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ করে এবং সুদের বিনিময়ে মুনাফার পরিমাণ বাড়ায়।


উপনিবেশের প্রসারে শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধনের ভূমিকা


শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধনকে কাজে লাগিয়ে সঞ্চিত মুনাফার পরিমাণকে বাড়িয়ে তােলা হয়। এক্ষেত্রে দরকার আরও বেশি, যত বেশি সম্ভব শিল্পপণ্যের উৎপাদন ও তা বিক্রয়। এই শিল্পপণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় ব্যাপারটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। শিল্পপণ্যের উৎপাদনের দিক থেকে বিচার করলে দরকার কাঁচামাল ও শিল্প উৎপাদনের যাবতীয় পরিকাঠামাে। অপরদিকে শিল্পপণ্যের বিক্রয়ের দিকটি বিচার করলে দরকার দেশীয় বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজার অর্থাৎ অনেক বড়াে। বিক্রয়ের ক্ষেত্র। এই চাহিদা মেটানাের সবথেকে ভালাে উপায় ছিল উপনিবেশ গঠন ও তার প্রসার ঘটানাে।


[1] কাঁচামাল জোগাড়: সামগ্রিকভাবে পণ্য উৎপাদনের অন্যতম শর্ত হল কাঁচামাল। এই কাঁচামাল সব সময়ে নিজের দেশে নাও পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিজ নিজ উপনিবেশ থেকে অনেক সস্তায় কাঁচামাল জোগাড়ের সুযােগ থাকে, সেই সুযােগের সৎ ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়ে ইউরােপের শিল্পোন্নয়নের দেশগুলি উপনিবেশ গঠনে ঝাপিয়ে পড়ে এবং একে-অপরের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়। নিজ নিজ দেশগুলিতে শিল্প কারখানার উৎপাদন। শিল্পপণ্যের উৎপাদন আরও বাড়ানাের জন্য দরকার আরও বেশি কাঁচামাল। আরও বেশি কাঁচামাল জোগাড়ের জন্য একটার পর একটা উপনিবেশ দখলের নেশায় ইউরােপের দেশগুলি মেতে উঠলে উপনিবেশবাদের প্রসার ঘটে।


[2] শ্রমিক জোগাড়: শিল্পপণ্য উৎপাদনের জন্য লাগে প্রচুর শ্রমিক। এক্ষেত্রে শিল্পগােষ্ঠীগুলি চায় কম মজুরিতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাতে। এর সহজ উপায় হল উপনিবেশগুলি থেকে শ্রমিকদের নিয়ে এসে কাজে লাগানাে। তাই এই বিচারে উপনিবেশগুলি থেকে শ্রমিক জোগাড়ের উদ্দেশ্য উপনিবেশ প্রসারের পরােক্ষ কারণ।


[3] পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের বাজার: শিল্পবিপ্লবের পর থেকে উন্নত প্রযুক্তি এবং নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রটি মজবুত করে দেয়, সেই সঙ্গে এনে দেয় পণ্য উৎপাদনগত বৈচিত্র্যও। শিল্প উৎপাদনকারী গােষ্ঠীগুলি নিজ দেশের বাজারকে ব্যবহার করার পাশাপাশি ইউরােপ এবং ইউরােপের বাইরে নানা দেশে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রয়ের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগকে সফল করার জন্য তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ গঠনে সচেষ্ট হয়। এভাবেই শিল্প ও পুঁজিবাদী মূলধন উপনিবেশের প্রসার ঘটায়।