ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলােচনা করাে।

সূচনা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রাচীন ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান চলত। কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান ও ধর্মীয় কাহিনি পাঠের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান সীমাবদ্ধ ছিল।


ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার

[1] সরকারি অনিচ্ছা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মনে করত যে, পাশ্চাত্য শিক্ষা, প্রভাবে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে এবং এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। এজন্য কোম্পানি এদেশে সংস্কৃত ও আরবি ফারসি শিক্ষাকেই উৎসাহ দেয়। এই উদ্দেশ্যে কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রি.), এশিয়াটিক সােসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.), বারাণসী সংস্কৃত কলেজ (১৭৯১ খ্রি.), ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।


বিদেশিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ: ভারতে সর্বপ্রথম একটি বদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানান কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চালর্স গ্রান্ট। ক্রমে এদেশে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি অফিস, আদালত, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি স্থাপিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভারতীয়দের ইংরেজি জ্ঞানের প্রয়ােজন ছিল। সরকারি চাকরি লাভের জন্য মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই চাহিদা মেটানাের জন্য কলকাতায় কিছু বিদেশি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল শােরবাের্ন, মার্টিন, বাউল, আরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়।


[2] শ্রীরামপুর মিশনারিদের উদ্যোগ: ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি বা ধর্মপ্রচারকগণ দেশের বিভিন্ন অঞলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের উদ্যোগে বাংলা-সহ মােট ২৭টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনূদিত হয়। তাদের উদ্যোগে কলকাতা, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থান, এমনকি চুঁচুড়া, বর্ধমান, কালনা, বহরমপুর, মালদা এবং দক্ষিণ ভারতেও বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮১৮ খ্রি.)।


[3] অন্যান্য মিশনারিদের উদ্যোগ: লন্ডন মিশনারি সােসাইটি ও চার্চ মিশনারি সােসাইটির। তাদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থান-সহ দক্ষিণ ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন' (১৮৩০ খ্রি.)। এ ছাড়া মিশনারিদের উদ্যোগে শিবপুরে 'বিশপ কলেজ' (১৮২০ খ্রি.), 'মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ' (১৮৩৭ খ্রি.), বােম্বাই-এ 'উইলসন কলেজ' (১৮৩২ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।


[4] অন্যান্যদের উদ্যোগ: কলকাতায় রামমােহন রায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলাে-হিন্দু স্কুল এবং ডেভিড হেয়ার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় (হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখােপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল বুক সােসাইটি’ (১৮১৭ খ্রি.) এবং ক্যালকাটা স্কুল সােসাইটি (১৮১৮ খ্রি.) বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক রচনায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠিত 'কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন' বা 'জনশিক্ষা কমিটি'-র সদস্যরা কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রামমােহন রায় তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠি লিখে (১৮২৩ খ্রি.) সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান।


[5] সরকারি ঘােষণা: ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি ঘােষণা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করে, যেমন—


  • [i] ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনের দ্বারা ঘােষণা করে যে, ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। 

  • [ii] জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘােষণা করেন। 

  • [iii] উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪ খ্রি.) অনুসারে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে।


উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লাহােরে, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার আরও প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশনের অনুসারে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান কমিয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিপুল চাহিদা থাকায় বেসরকারি উদ্যোগে সারা ভারতে একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।


ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের কারণ। ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট


ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান আলােচনা করাে।


পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ সম্পর্কে উল্লেখ করাে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ করাে।