ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের কারণ | ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট

সূচনা: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির জয়লাভের পরবর্তীকালে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। এই সময় মােটামুটি সচ্ছল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা হয়।


ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট

[1] সরকারি চাকরি: ভারতে প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক প্রসারের সূত্রে এদেশে প্রশাসনের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য এত বিপুল সংখ্যক কর্মচারীর প্রয়ােজন ছিল যে, বিলেত থেকে তা আনা সম্ভব ছিল না। তাই প্রশাসনের নিম্নস্তরের বিপুল সংখ্যক চাকরির পদে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা নিযুক্ত হওয়ার সুযােগ পায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল এই ভারতীয় কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


[2] আইনজীবী: সাম্রাজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বহু ভারতীয় অত্যন্ত লাভজনক আইনের পেশা গ্রহণ করে। ব্রিটিশ-ভারতের আদালতগুলিতে আমলা, উকিল, মােক্তার, কেরানি, মুহুরি ও অন্যান্য বিভিন্ন কাজে শিক্ষিত ভারতীয়রা নিযুক্ত হতে থাকে। এই পেশায় প্রবেশ করে তাদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে। শিক্ষিত ও সচ্ছল এই ভারতীয় সম্প্রদায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


[3] করণিকের কাজ: ইংরেজরা ভারতে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর এদেশে প্রচুর স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এসব প্রতিষ্ঠানে করণিক পদে প্রচুর সংখ্যক ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারীর প্রয়ােজন হয়। সরকারি বেতনভুক্ত এই নিম্নবর্গের করণিকগণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।


[4] সামরিক বিভাগের কর্মী: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সামরিক বিভাগের উচ্চপদগুলি ইংরেজদের জন্য নির্ধারিত হলেও নিম্ন পদগুলিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত ভারতীয় নিযুক্ত হয়। সরকারি বেতনভুক্ত সচ্ছল এই কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।


[5] ব্যবসায়ী: বাণিজ্যের প্রসার ঘটানাের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ও ব্যক্তিগত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ভারতের দূরদূরান্তের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিশালাকার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য প্রচুর কর্মচারীর প্রয়ােজন ছিল। ব্রিটিশ বণিক ও পুঁজিপতিরা তাদের বাণিজ্যিক কাজকর্ম সচল রাখতে বহু শিক্ষিত ভারতীয়কে বিভিন্ন পদে নিয়ােগ করে। বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত এসব ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।


[6] শিল্পের কাজ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে শিল্পের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। শিল্প ও শিল্পকারখানাগুলির কাজকর্ম পরিচালনার জন্য প্রচুর শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারী নিযুক্ত হয়। শিল্পের কাজে নিযুক্ত এসব শিক্ষিত ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম অংশ ছিল।


[7] ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভােগী: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে কিছু জমিদার বা ভূস্বামী শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। তারা প্রধানত প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করত। ভূস্বামীর পক্ষ থেকে প্রজার কাছ থেকে কর আদায়ের কাজটি করত মধ্যস্বত্বভােগী শ্রেণির বহু মানুষ। বিপুল অর্থের অধিকারী এই জমিদার, ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভােগীরা ইংরেজদের অনুগত শ্রেণি হিসেবে নিজেদের পেশা ও উপার্জনকে সুনিশ্চিত করেছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণেও এগিয়ে এসেছিল।


[8] মহাজন: ব্রিটিশ সরকার এদেশে চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি প্রভৃতি ভূমি বন্দোবস্ত চালু করলে ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভােগীদের রাজস্বের চাপে দরিদ্র কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। নগদ কর আদায়ের উদ্দেশ্যে কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ শাসনের অনুগামী এই মহাজন শ্রেণি ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ ছিল।


উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা সংখ্যায় খুবই অল্প হলেও দেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এই শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই শ্রেণিই মূলত ভারতের ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছিল। আবার উনিশ শতকে বাংলায় যে, নবজাগরণ ঘটেছিল তার অগ্রভাগে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা।


ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান আলােচনা করাে।


ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ সম্পর্কে উল্লেখ করাে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ করাে।