১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপট ও শর্তাবলি আলােচনা করাে। এই আইনের গুরুত্ব কী ছিল?

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপট

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন উপাদান সক্রিয় ছিল। যেমন一


[1] মন্ট-ফোর্ড আইনের ব্যর্থতা: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন প্রণয়নের পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। এই আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা ভারতে প্রবল গণ আন্দোলন শুরু হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই সময় বিপ্লববাদী কার্যকলাপও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসার ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তােলে।


[2] সাইমন কমিশনের রিপোর্ট: এই সময় ভারতীয়রা স্বায়ত্তশাসন লাভের উপযুক্ত কিনা তা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে সাইমন কমিশন ভারতে আসে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কমিশনের রিপাের্টে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর সুপারিশ করা হয়।


[3] গােলটেবিল বৈঠক: সাইমন কমিশনের রিপাের্টের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার উদ্যোগ নেয়। প্রথম (১৯৩০ খ্রি.), দ্বিতীয় (১৯৩১ খ্রি.) ও তৃতীয় (১৯৩২ খ্রি.)—এই তিনটি গােলটেবিল বৈঠকের আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার নতুন সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়ােজন অনুভব করে। শেষপর্যন্ত সাইমন কমিশনের রিপাের্ট ও গােলটেবিল বৈঠকের আলােচনা ও প্রস্তাবগুলির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতের সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবসমূহ নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে (১৯৩৩ খ্রি.)। অতঃপর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে এই সকল প্রস্তাব এবং যৌথ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভারত শাসন আইন বা Government of India Act, 1935 পাস হয়।


1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের শর্তাবলি


[1] যুক্তরাষ্ট্র গঠন: এই আইনে ব্রিটিশ শাসনাধীন রাজ্য ও বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার দেওয়া হয় বড়ােলাট ও তার অধীনস্থ একটি মন্ত্রীসভার হাতে।


[2] কেন্দ্রীয় সরকার: ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনে কেন্দ্রে পাঁচ বছর মেয়াদি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠনের কথা বলা হয়। কেন্দ্রে মুসলিম সদস্যদের জন্য সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং তপশিলি সদস্যদের পুনা চুক্তি (১৯৩২ খ্রি.)র ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে সংরক্ষিত (পররাষ্ট্র সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, সেনাবাহিনী, রেলপথ ইত্যাদি বিষয়) এবং হস্তান্তরিত (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণের মতাে বিষয়গুলি) দপ্তরে রেখে কেন্দ্রে এক দ্বৈত শাসনব্যবস্থার (Dyarchy) প্রচলন ঘটানাে হয়। কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালনার কাজে বড়ােলাটকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়।


[3] প্রাদেশিক সরকার: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান করা হয়। কেন্দ্রের অনুকরণেই প্রদেশগুলােরও শাসনকাঠামাে গঠন করা হয়। তবে প্রদেশগুলিতে আইনসভা এককক্ষ বা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট উভয়ই হতে পারত। প্রদেশের ছােটোলাট বা গভর্নর তাঁর মন্ত্রীপরিষদের সাহায্যে শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পান। তার হাতে বিশেষ ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়।


[4] ক্ষমতার বণ্টন: ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তােলার কথা বলা হয় সেখানে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের উদ্দেশ্যে তিনটি তালিকা তৈরির কথা বলা হয়। যথা


  • কেন্দ্রীয় তালিকা: এর মধ্যে ছিল বিদেশনীতি, রেল, ডাক, মুদ্রা প্রভৃতি।

  • প্রাদেশিক তালিকা: এর মধ্যে ছিল শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পুলিশ, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয় ইত্যাদি।

  • যুগ্মতালিকা: এর অন্তর্ভুক্ত ছিল মুদ্রণ, সংবাদপত্র, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি।


[5] প্রাদেশিক বিভাজন: ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন দ্বারা ভারতের প্রদেশগুলিকে দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা


  • গভর্নর শাসিত প্রদেশ: এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশসহ মােট ১১টি প্রদেশ।

  • চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ: এর অন্তর্ভুক্ত ছিল মাড়ােয়ার, আজমীর, বেলুচিস্তান, কুর্গ এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এই পাঁচটি প্রদেশ।


১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব


১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনও ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তবুও এই আইন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল


[1] যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের ভিত্তি রচনা: ১৯৩৫-এর ভারতশাসন আইনের দ্বারা ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রদান করা হয়। তাই এই আইনের ফলে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।


[2] দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন: এই আইনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টনের মধ্য দিয়ে এক দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।


[3] ভােটাধিকার বৃদ্ধি: ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের দ্বারা প্রথম বারের জন্য সরাসরি নির্বাচন উপস্থাপন করা হয়। পাশাপাশি ভােট দেওয়ার অধিকারও বৃদ্ধি করা হয়।


[4] ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তি: স্বাধীন ভারতের সংবিধানের যে কাঠামােটি আমরা দেখি তা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।


[5] স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের বহুদিনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের বাসনা পূরণ করে। এই আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলি যেটুকু স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেয়েছিল, জিন্না ও মুসলিম লিগ তার প্রশংসা করে।